১০ ডিসেম্বর বিএনপি’র মহাসমাবেশকে সামনে রেখে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল ফ্যাসিবাদের সহায়ক পুলিশ। সমাবেশের তখনো ৩দিন বাকী। ৭ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় বিকালে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়েছিল বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। তখনই অভিযানে আসে পুলিশ। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গুলি চালিয়ে একজনকে হত্যা করা হয়। গুলিতে আহত হয়েছেন আরো অনেকে।
রাষ্ট্রীয় টাকায় (জনগনের ট্যাক্সে) এই পুলিশের বেতন হয়। তাদের দায়িত্ব জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ পণ্ড করতে পুলিশ বিএনপি অফিসের সামনে গুলি চালায়। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকে অনেক সিনিয়র নেতাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। কার্যালয়ের ভেতরে আশ্রয় নেওয়া কর্মীদের গ্রেফতার করা হয় পাইকারি হারে।
গুলি চালিয়ে নিহত এবং আহত করে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থেকে গ্রেফতারেই শেষ নয়। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরে রীতিমত তাণ্ডব চালিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের তাণ্ডবে তছনছ করা হয়েছে আসবাবপত্র। নিয়ে গেছে অনেক মূল্যবান দলীয় কাগজপত্র। পরবর্তীতে নয়াপল্টনে বিএনপি’র কার্যালয়ে তল্লাশি ও বোমা উদ্ধারের নাটক সাজানো হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে। মূলত: ৭ ডিসেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয়াপল্টনের কার্যালয়টি পুলিশের নিয়ন্ত্রণেই ছিল।
অথচ অভিযানের পর পুলিশের কাজে বাঁধা ও বিস্ফোরক আইনে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে উল্টা মামলা করেছে রাষ্ট্রীয় এই বাহিনী।
এপর্যন্ত যতটুকু উল্লেখ করেছি সবই পাঠকরা জানেন। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ এখন তাৎক্ষনিক সব খবর পেয়ে যায়। তারপরও উল্লেখ করলাম ঘটনা গুলোর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। আমার আজকের লেখার মূল বিষয় হচ্ছে, এই অভিযানে পুলিশের যেসব কর্তা ব্যক্তিরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। পুলিশের বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় ধারাবাহিকভাবে নিচে দেওয়া হল-
পুরো এই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মেহেদী হাসান ও আরেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। এই দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা আওয়ামী জামানার শুরু থেকেই বিরোধী দলের প্রতি মারমুখী অবস্থানে রয়েছেন। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে দলটির মহাসচিবসহ অনেক সিনিয়র নেতাকে গ্রেফতারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মেহেদী হাসান। তখন তিনি মতিঝিল জোনের ডিসি ছিলেন। বরাবরই এই পুলিশ কর্তা সরকারি প্রাইজ পোস্টিংয়ে আছেন।
বিপ্লব কুমার সরকার বিরোধী দলের সাবেক চীফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুককে রাজপথে পিটিয়ে দুনিয়াব্যাপি মানবাধিকার কর্মীদের নজর কেড়েছিলেন। এরপর থেকে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিপ্লব কুমার।
চিহ্নিত এই দুইজনের সঙ্গে অভিযানের নেতৃত্বে আরো যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন মতিঝিল জোনের বর্তমান ডিসি হায়াত, মতিঝিল জোনের এসি গোলাম রোহানি ও পল্টন থানার ওসি।
তাদের নেতৃত্বে অভিযানের পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরে তল্লাশির নামে তাণ্ডব চালানো এবং বোমা উদ্ধার নাটকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ডিবির ডিসি কমিশনার হারুনুর রাশিদ, ডিবির যুগ্ম কমিশনার নুরুন্নবী, যুগ্ম কমিশনার সঞ্জয়।
এসময় সঙ্গে আরো ছিলেন-ডিবির সাইবার টিমের ডিসি তারিক বিন রশিদের টিম। তারা বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে তছনছ চালান এবং কার্যালয়টির সিসি ক্যামেরা ভাংচুর করেন। পরবর্তীতে কম্পিউটার ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে নিয়ে যায় তারিক বিন রশিদের টিম।
বিএনপি’ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চলাকালীন পুলিশের সোয়াট টিমের একটি গাড়ি দেখা গিয়েছিল। সোয়াট টিমের এডিসি জাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে তাঁর অধীনস্থ টিমের সদস্য এম-১৬ রাইফেল নিয়ে অভিযানে যোগ দিয়েছিল। কথিত জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এই রাইফেল দিয়েছিল আমেরিকা। এ রাইফেল এখন বিরোধী দলের সমাবেশ পণ্ড করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
উপরের এই তথ্য গুলো পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রাপ্ত। এই সূত্রটি আরো জানায়, পল্টন থানার ওসি সালাউদ্দিন ২০০৩ সালে চার দলীয় জোট সরকারের আমলে পুলিশের চাকুরিতে প্রবেশ করেন। তার বিরুদ্ধে তখনই অনেক অভিযোগ উঠেছিল। ট্রেনিংয়ে পাসিং আউটের ৭ দিন আগে ২০০৪ সালে সারদা থেকেই চাকুরি চলে যায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে চাকুরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া মতিঝিলের এসি গোলাম রোহানি ছাত্রলীগের সাবেক বিতর্কিত সেক্রেটারি গোলাম রব্বানীর ছোট ভাই। বিএনপি অফিসে অভিযানের সময় ছাত্রলীগের সাথে সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল এই গোলাম রোহানির।
বিকালে বিএনপি অফিসে অভিযানের পর রাতে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আটক করে ডিবির পৃথক দু’টি টিম। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসায় অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- এসবি’র এডিশনাল ডিআইজি রাশিদুল মির্জা, ডিবির লালবাগ জোনের ডিসি মশিউর রহমান ও উত্তরা জোনের আকরাম হোসেন এবং উত্তরার এডিসি বদরুজ্জামান জিল্লু। তারা সকলেই ডিবির অফিসার।
মতিঝিলে মির্জা আব্বাসের বাড়িতে অভিযানে গিয়েছিলেন ডিবির মতিঝিলের ডিসি হায়াতুল ইসলাম, এডিসি গোলাম রুহানি ও খিলগাঁও থানার ওসি ফারুক হোসেন।