সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে বিএনপি। গত সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই রূপরেখা তুলে ধরেন। যেখানে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সরকার গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে ‹জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐক্যমত্যের সরকার› প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার কমিশন, রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পরপর দুই টার্মের বেশি দায়িত্ব পালন করতে না পারা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন, নির্বাচন কমিশন আইন সংশোধন, জুডিশিয়াল, প্রশাসনিক সংস্কার, মিডিয়া, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে।
বিএনপি ঘোষিত এই রূপরেখাকে যুগান্তকারী, ইতিবাচক হিসেবেই বিবেচনা করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ২ বার, কমিশন গঠন, নানাবিধ সংস্কারের বিষয়গুলো আকৃষ্ট করেছে তাদের।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক বিএনপি ঘোষিত ২৭ দফা রূপরেখার বিষয়ে বলেন, রূপরেখায় যুগান্তকারী কিছু বক্তব্য আছে। বিশেষ করে, দ্বিকক্ষ পার্লামেন্টের কথা, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুইবার, ৫টি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। এগুলো যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এগুলোর কারণে জনগণের মনে আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ইনশাআল্লাহ আগামী দিনের বাংলাদেশ অনেক বেশি নিরাপদ ও উন্নতিশীল হবে।
গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, বিএনপি ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখাটি খুব সময়োপযোগী এবং অত্যন্ত চমৎকার। সেখানে যেসব বিষয় বলা হয়েছে তার প্রত্যেকটা জিনিস খুব ভালো লেগেছে। তারা রূপরেখার মাধ্যমে যে ভিশন দিয়েছে তা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কিছু তারা এখানে এনেছে যেটা দেশবাসী মনে করে করা খুব প্রয়োজনীয়। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমরা দলগতভাবে কতগুলো দফা ঘোষণা করেছি যার বেশকিছু বিএনপির রূপরেখার মধ্যে রয়েছে। আমরা তাদের রূপরেখাকে স্বাগত জানাই। এছাড়া উনারা বলেছেন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুইবারের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবে না, এটা ঠিক আছে, করতে পারলে খারাপ হবে না।
তবে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো আসেনি জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো নিয়েও আমরা কথা বলবো। আমরা বোথ পলিটিক্যাল, ডেমোক্রেটিক, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এন্ড ইকোনমিক টোটাল প্রোগ্রাম দিতে চাই। যাতে দেশটা বদলানো যায়। আমরা মনে করি এটা সম্ভব। উনারা জাতীয় সরকারের কথা বলেছে, নির্বাচনের পর। এখানে আমাদের কোন বক্তব্য নেই। কিন্তু আমরা এখন যে সরকার চাচ্ছি, সেটা তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তীকালীন, জাতীয় সরকার বলেন বা যে নামে ডাকেন তার কাজ হবে এই আলোচনার পুরো ভিত্তি তৈরি করা।
যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি বিএনপির রূপরেখা। আমরাও একটি দফা ঘোষণা করেছি। এরপর আমাদের লিয়াজো কমিটি হবে, সেটি শুধু কর্মসূচি ঠিক করবে না, প্রোগ্রাম আলোচনা করবে। তারা যা দিয়েছে, আমরা যা দিবো- সেখানে একসাথে করে একটি প্রিন্সিপাল তৈরি করা হবে। যার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন এগিয়ে যাবে।
‘গণতন্ত্র মঞ্চের’ আরেক নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বিএনপির দেওয়া রূপরেখার বিষয়ে বলেন, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে হলে সরকার এবং শাসনব্যবস্থা উভয়েরই পরিবর্তন দরকার। বিএনপির মতো বড় দল যখন রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রস্তাব হাজির করে, তখন এটি রাজনীতিতে প্রধান আলোচ্য হয়ে যায়। এটি রাজনীতির জন্য ইতিবাচক।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ শুরু থেকেই রাষ্ট্র মেরামত করার কথা বলে এসেছে। রাষ্ট্র মেরামতের বক্তব্যকে গণদাবিতে পরিণত করতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা আমীর দলের নামই রেখেছিলেন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। আজকে যখন রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা নিয়ে অতীতে ক্ষমতার স্বাদ নেয়া; বর্তমান বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে এবং তারা একটি ঘোষণা দিয়েছেন তখন আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখা প্রস্তাবনা নিছকই রাজনৈতিক বক্তব্য না বরং দৃঢ় সদিচ্ছার প্রতিফলন।
তিনি বলেন, তবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করিয়ে দিতে চায় যে, বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের মেরামতের প্রসঙ্গে নীতিমালা হিসেবে ইসলামকে ভিত্তি না ধরলে দেশ আবারো পথ হারাবে। ইসলাম এদেশের মানুষের হাজার বছরের আনন্দ-কান্না, আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধান প্রেরণা। হাজার বছর ধরে ইসলাম এদেশের মানুষকে পথ দেখিয়েছে। সেই মানুষদের ভূখন্ডে গঠিত রাষ্ট্রের মেরামতে ইসলামই একমাত্র সমাধান। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরে যারাই ক্ষমতায় ছিলো তারাই এই মেরামতযোগ্য অকার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থার সুযোগ নিয়েছে। ইতোপূর্বে ক্ষমতায় থাকা সবগুলো দলের প্রবণতা একই রকম ছিলো ও আছে।
মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, অসৎ নেতৃত্ব যে কোন ভালো চিন্তা ও উদ্যোগকে সর্বনাশ করে দিতে পারে; যা বারবার প্রমাণিত। দেশে বিগত ৫২ বছরে কোন সরকারই একটি টেকসই ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। বিরোধী দল রাষ্ট্র মেরামতের কথা বললেও নির্বাচন ব্যবস্থার বিষয়ে নতুন কোন টেকসই প্রস্তাবনা দিতে পারেনি। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আগামী ২ জানুয়ারীর জাতীয় সম্মেলনে এ বিষয়ে পুর্ণাঙ্গ ও টেকসই একটি রূপরেখা ঘোষণা করবে ইনশাআল্লাহ।
রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখার প্রতি পুর্নসমর্থন ব্যক্ত করে ইসলামী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিব বলেন, গণতন্ত্রের বিকাশ লাভ এবং গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখা সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তিনি বলেন, বিএনপির প্রস্তাবিত ২৭ দফা রূপরেখাকে বাকা চোখে না দেখে তা’বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিন। বিএনপি জনগণের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যেই ২৭ দফা রূপরেখা পেশ করেছে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তুচ্ছ্যতাচ্ছিল্য বন্তব্য করা মোটেই উচিত নয়।
রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে বাংলাদেশ বিএনপির প্রস্তাবিত ২৭ দফা রূপরেখার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য। মঙ্গলবার সকালে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখা পর্যালোচনা করে এ সমর্থন ব্যক্ত করেন জোটের নেতৃবৃন্দ।
গত সোমবার বিকেলে রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে ২৭ দফা রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়। বিএনপি জানিয়েছে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ঘোষিত বিএনপির ভিশন-২০৩০ এর আলোকে এ রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে।
রূপরেখা তুলে ধরতে গিয়ে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়া এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাদের হাতে নেই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। উক্ত ‘জাতীয় সরকার’ রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করবে।