মিনার রশিদ
রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতের নিমিত্তে বিএনপি তাদের ২৭ দফা কর্ম পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এটা দেখে আওয়ামী বলয়ের প্রতিক্রিয়া গুলো খুবই চিত্তাকর্ষক লাগছে। ওবায়দুল কাদের সহ কয়েকজনের মন্তব্য এই শুষ্ক হৃদয়টিকেও মনে হয় ভিজিয়ে ফেলেছে! মনে পড়ছে রবি ঠাকুরের সেই কবিতা খানি- প্রহর শেষের আলোর রাঙায় সেদিন চৈত্রমাস/তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা একটি স্ট্যান্টবাজি। হাসান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপি নেতাদের মুখে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা হাস্যকর। আলগা মোমেন হতাশার রশিটাকে আরেকটু আলগা করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপির ২৭ দফা হাস্যকর, মানবাধিকারের কথা ভাঁওতাবাজি! আমু বলেছেন, বিএনপির ২৭ দফা যুদ্ধাপরাধীদের স্বীকৃতির দলিল! ৭১ টিভি জানিয়েছে, ২৭ দফার একটি দফাও পছন্দ হয় নি আওয়ামীলীগের! জনকণ্ঠ সহ আওয়ামী ঘরানার পত্রিকাগুলো লিখেছে, তাদের এই মেরামতের প্রস্তাব মূলত বাংলাদেশের অর্জনগুলোকে, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র।
এগুলো দেখে নিজের ভেতরের চেতনাকে যতটুকু সম্ভব শানিত করে একটা ডুবুরি নামিয়ে দিলাম ২৭ দফার কোন জায়গাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত কথাগুলি রয়েছে অথবা যুদ্ধাপরাধীদের স্বীকৃতির দলিল কোথায় লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করার জন্যে। এই ২৭টি দফা বুলেট আকারে সবার বিবেচনায় পেশ করা হল। আপনারাও খুঁজুন! দরকার পড়লে বিস্তারিত রূপরেখাগুলি পড়েন!
সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন
জাতীয় সমঝোতা কমিশন গঠন
নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়ন
দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী না থাকা
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন
নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন সংশোধন
সাংবিধানিক সব কমিটি পুনর্গঠন
জুডিশিয়াল কমিশন গঠন
প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন
মিডিয়া কমিশন
ন্যায়পাল নিয়োগ
সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন
ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার মূলনীতির ভিত্তিতে ধর্ম পালনে পূর্ণ অধিকার ও পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান, আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ ও সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি।
মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা ।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল ও অপ্রয়োজনীয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ,
বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া,
দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করা,
ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারগুলোকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা,
নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের তালিকা প্রণয়ন ও যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান,
আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন,
নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ,
নিম্ন ও মধ্যপর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-কারিকুলামকে প্রাধান্যসহ জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ,
‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই নীতির ভিত্তিতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন ও জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ,
কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।
মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে দিনের ভোট রাতে করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে দশ হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতু ত্রিশ হাজার কোটি টাকায় করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে ১৪ বছরে ৭ লাখ কোটি টাকা বাইরে পাচার করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে দেশের একটি বৃহত্তম ব্যাংক দখল করে জনগণের পকেট থেকে এক লাখ কোটি টাকা লুট করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে দেশের সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি ভিন্নমতের বা ভিন্ন আদর্শের লোকদের গুম, হত্যা করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি বিরোধী দলের নেতাকে গায়েবি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ডাণ্ডাবেরি পরিয়ে মায়ের জানাজা পড়তে দেওয়া?
মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে মাংসের পরিবর্তে কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে দেশটিকে অন্য একটি দেশের করদ রাজ্যে পরিণত করে ফেলা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি তাহলে কুইক রেন্টালে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লাখ লাখ কোটি টাকা লুট করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি শেয়ার বাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা লুট করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা রাজকোষ থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার হাওয়া করে দেওয়া? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি এসব কথা যেন কেউ উচ্চারণ করতে না পারে তজ্জন্যে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা? মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কি সিঙ্গেল ইউনিটের চমৎকার এই জাতি রাষ্ট্রটিকে সর্বনাশা দুইভাগ করা?
আসলে চেতনার নামে দেশ ও জাতির যে সর্বনাশটি করা হয়েছে বিএনপির ঘোষিত ২৭ দফায় এর প্রত্যেকটি মেরামত ও সংস্কারের মূল ফর্মুলাটি দেওয়া হয়েছে! বিএনপির টপ নেতৃত্ব থেকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা স্পষ্ট করা হয়েছে। বিএনপির উপর জনগণের প্রত্যাশা এতটুকু বেড়ে গেছে যে ক্ষমতায় গেলে এই দফাগুলির বাস্তবায়ন থেকে সরে আসা বিএনপির পক্ষে অসম্ভব হবে। বিশেষ করে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী না থাকা, ন্যায়পাল নিয়োগ আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির চেহারা পুরো পাল্টে দিতে পারে!
লুটপাটের খুদকুঁড়া রক্তে কিংবা চেতনার বীজ মগজে ঢুকলে রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়! চেতনার এক প্রফেসর জানিয়েছেন তিনি ভোটের আগের রাতে ঘুমিয়ে সকালে যদি দেখেন মুক্তিযুদ্ধের একটি পক্ষ জিতেছে তাতেই তিনি মহাখুশী! অর্থাৎ আগের রাতে যে নৈশ ভোট সংঘটিত হলো সেটা নিয়ে উনার কোনো উদ্বেগ নেই। কী ভয়ংকর এক নরসুন্দরকে আমরা জাতির বিবেক বানিয়ে রেখেছিলাম! মূলত: তারই প্রেসক্রিপশনে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ‘আই অ্যাম এ জিপিএ ফাইভ’ হয়ে গেছে কিংবা পিনাকীদার উচ্চারণে পুরাপুরি জয়বাংলা হয়ে গেছে! এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশনে তাড়িত হয়ে বা চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে এই লোকটির বই নিজেদের বাচ্চাদের হাতে তুলে দিয়েছি! অনেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক আদিখ্যেতায় এই মাকাল ফলকে মাথায় তুলে রাখি!
এক প্রাক্তন আমলা মহকুমা প্রশাসক বা এসডিও থাকাবস্থায় এক গ্রাম পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং জনৈক বিশিষ্ট ব্যক্তির আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। নিজের বাড়িতে এমন হাতির পা পড়ায় বেচারা অত্যন্ত শশব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এত্তো বড় মেহমানকে কী খাওয়াবেন না খাওয়াবেন সেটা নিয়ে মহা মহা গ্যাঞ্জাম বাঁধিয়ে ফেললেন! সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি ঘটিয়েছিলেন চা খাওয়ানো নিয়ে। ভদ্রলোকের মনে হলো, এতো গণ্যমান্য মেহমান! কাজেই চায়ে একটু আতর ঢেলে দিলে তা আরও সুঘ্রাণ ছড়াবে এবং অত্যন্ত উপাদেয় হবে। বেচারা এসডিও সাব পড়ে গেলেন মহা মুসিবতে। আতর মিশ্রিত সেই তিতা চা পান করে হোস্টকে খুশি করার মানসে দেখাতে হলো চাটি অত্যন্ত উপাদেয় হয়েছে!
এই এসডিও সাবের মত দেশবাসী পড়েছে বিকট সমস্যায়। আমাদের সংবিধানকে বিশেষ চেতনায় চেতনায়িত করতে গিয়ে অনেক আওয়ামী আতর ঢেলে দিয়েছে। এর মধ্যে একটি আস্ত ভাষণও ঢুকানো হয়েছে! এটি যতই তিতা হোক না কেন, সবাইকে বলতে হচ্ছে, অত্যন্ত সুস্বাদু হয়েছে। আতরের সুন্দর ও পবিত্র ব্যবহার রয়েছে, তাই বলে সেটা চায়ের মধ্যে ঢেলে নয় । এই হিতাহিত জ্ঞানটিই এই চেতনাবাজরা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে সেই চেতনার আতর রাজনীতি, প্রশাসন, বিচারালয়, শিক্ষালয় সহ সবজায়গায় মিশিয়ে জাতীয় জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। দুনিয়ার অন্যান্য সভ্য জাতির সংবিধানের মধ্যে এর দ্বিতীয় কোনো নমুনা আছে কি? এখন কেউ যদি নিজেদের প্রিয় ধর্মগ্রন্থকে হুবহু সংবিধানে ঢুকিয়ে দেন, তবে এই উর্বর মস্তিষ্কের বিরোধিতা কি ধর্মের বা সংবিধানের বিরোধিতা বলে গণ্য হবে?
এরকম শত শত প্রশ্ন জনগণের মনে উঁকি দিচ্ছে? কাজেই বাকশাল যেখানে নিজের সর্বনাশ দেখছে সঙ্গত কারণেই আপামর জনতা সেখানেই মুক্তির নিশানা খুঁজে পেয়েছে! সকল আলামত দেখে মনে হচ্ছে, মুক্তির সেই সুবেহ সাদেক খুব বেশি দূরে নয়!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবী