ভারতের হায়দরাবাদের অষ্টম ও শেষ নিজাম (শাসক) ছিলেন নবাব মীর বরকত আলি খান বালাশন মুকাররম জাহ বাহাদুর। গত ১৪ জানুয়ারি ৮৯ বছর বয়সে তুরস্কের ইস্তানবুলে মারা যান তিনি। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী গতকাল বুধবার রাতে পূর্বপুরুষদের রাজধানী শহরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। মুকাররম জাহর দপ্তর থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ইস্তানবুল থেকে হায়দরাবাদে নিয়ে আসার পরে তার মরদেহ চৌমহলা প্যালেসে রাখা ছিল। তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজার হাজার মানুষ হাজির হয়েছিলেন ওই প্যালেসে।
হায়দরাবাদের শেষ নিজাম মীর উসমান আলি খান বাহাদুরের নাতি ছিলেন এই মুকাররম জাহ। সপ্তম নিজাম মীর উসমান আলি খান ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত হায়দরাবাদের শাসক ছিলেন। তার ছেলে, আজম জাহ ও রাজকুমারী দুরু শহবরের ছেলে মুকাররম জাহের জন্ম হয় ১৯৩৩ সালে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উসমান আলি খান উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজের ছেলেকে বেছে না নিয়ে নাতি মুকাররম জাহকে পরবর্তী নিজাম হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৬৭ সালে রাজ্যাভিষেকর পরে অষ্টম নিজাম হন মুকাররম জাহ। সেই রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানও হয়েছিল চৌমহলা প্যালেসেই, যেখানে দাফনের আগে তার মরদেহ রাখা হয়েছিল। অভিষেকের পরেই মুকাররম জাহ অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। কিছুদিন পরে তুরস্কে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন তিনি।
হায়দরাবাদ থেকে প্রকাশিত ‘সিয়াসত’ সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, সপ্তম নিজামের উত্তরাধিকারী হিসেবে মুকাররম জাহ পৃথিবীর সব থেকে বড় সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু বিলাসী জীবনযাপন, রাজকীয় মহলের দেখভালে অবহেলা, বেহিসাবির মতো দামী অলঙ্কার কিনতে খরচ করা ছিল মুকাররম জাহের স্বভাব। সেভাবেই সব সম্পত্তি শেষ হয়ে যায় অষ্টম নিজামের।
উত্তরাধিকার সূত্রে মুকাররম জাহ ২৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি পেয়েছিলেন। সেই সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর। কিন্তু বেহিসাবি জীবনযাপনের ফলে শেষ দিনগুলো তাকে কাটাতে হয়েছিল একটা দুই কক্ষের ফ্ল্যাটে।
হায়দরাবাদের যে নিজাম শাসনের শুরু হয়েছিল ১৭২৪ সালে, তা চালু ছিল ১৯৪৮ পর্যন্ত। হায়দরাবাদের সপ্তম নিজাম আসফ জাহ মুজফ্ফরুল মুল্ক স্যার উসমান আলি খান ১৯১১ সালে শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের খুব কাছের মানুষ।
টাইম ম্যাগাজিন ১৯৩৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি উসমান আলি খানকে নিয়ে পুরো একটি সংখ্যা ছেপেছিল। সেই সময়ে তিনিই ছিলেন বিশ্বের সবথেকে ধনী মানুষ।
তার কাছে ২৪২ ক্যারেটের ‘জেকব’ হীরা ছিল। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরেগুলোর একটা। যারা ওই হীরা দেখেছেন, তাদের কথায়, হীরাটি একটা ছোট লেবুর আকৃতির ছিল।
ওই হীরা রক্ষা করার জন্য সেটিকে একটা সাবানের বক্সের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হত। কখনো আবার নিজাম সেটিকে পেপারওয়েট হিসাবেও ব্যবহার করতেন।
স্বাধীনতার পরে যে তিনটি দেশীয় রাজ্য ভারতে যোগদান করতে অস্বীকার করেছিল, তারই অন্যতম ছিল হায়দরাবাদ। তবে ভারত সরকার সেনাবাহিনী পাঠিয়ে ১৯৪৮ সালে হায়দরাবাদকে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।
হায়দরাবাদের সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরে ভারত সরকার নিজামের সমর্থক কাশিম রিজভি এবং লায়েক আহমেদকে হেফাজতে নেয়। লায়েক আহমেদ হেফাজত থেকে পালিয়ে বোম্বে (বর্তমানের মুম্বাই) চলে যান। আর সেখান থেকে বিমানে করে পাকিস্তান পৌঁছান।
কিন্তু ভারত সরকার সপ্তম নিজাম বা তার পরিবারের কোনো ক্ষতি করেনি। তাদের সপরিবারে নিজেদের প্রসাদেই থাকার অনুমতি দিয়েছিল সরকার। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরে ৫৬২তম দেশীয় রাজ্য হিসেবে হায়দরাবাদ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
সপ্তম নিজাম ও ভারত সরকারের মধ্যে ১৯৫০ সালের ২৫ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী নিজাম বছরে ৪২ লাখ ৮৫ হাজার ৭১৪ টাকা প্রিভি পার্স হিসাবে পেতেন। হায়দরাবাদ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও নিজাম সেখানকার গভর্নর ছিলেন ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত।
রাজ্য পুনর্গঠনের পরে নিজামের পূর্বতন সাম্রাজ্য ভেঙে তিনটি রাজ্য তৈরি হয়। সেগুলো হলো অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্র। সপ্তম নিজাম মীর উসমান আলি খান ১৯৬৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান।