নুরুল ইসলাম। বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার পশ্চিম কানাইনগর এলাকায়। অভাবের কারণে পড়াশোনা করতে পারেননি। একপর্যায়ে ২০০৯ সালে টেকনাফ স্থলবন্দরে চুক্তিভিত্তিক দৈনিক মাত্র ১৩০ টাকা বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে মাস্টাররোলে চাকরি শুরু করেন। চাকরির পাশাপাশি জড়ান ইয়াবা কারবারে। ইয়াবা ব্যবসার টাকা বৈধ করতে ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে ঢাকায় এসে খোলেন আমদানি-রপ্তানির তিনটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান। এর পরবর্তী ১২ বছরে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান নুরুল ইসলাম। ঢাকার মোহাম্মদপুর ও আদাবরে এখন তিনি পাঁচটি বাড়ির মালিক। এছাড়া টেকনাফ ও সাভারে জমি রয়েছে তার।
গত ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মাদক ও জাল টাকাসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নুরুলের রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার তথ্য মেলে। এরপর বিষয়টি তদন্তের জন্য র্যাব থেকে চিঠি দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। এছাড়া এ বিষয়ে সিআইডিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটও চিঠি দেয়।
এরপর গত ১৫ মাস তদন্ত শেষে নুরুল ইসলামের এসব অবৈধ সম্পদ থাকার খোঁজ পায় সিআইডি। অন্যদিকে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর র্যাবের করা মামলায় জামিন পেয়ে কারামুক্ত হন নুরুল ইসলাম। এরপর আর তাকে প্রকাশ্য দেখা যায়নি। তবে কিছুদিন আগে নুরুল ইসলামকে কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। তিনি এসব সম্পদের কোনো বৈধ উৎস বা বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি বলে জানিয়েছেন সিআইডি কর্মকর্তারা। তবে নুরুল ইসলাম আবার গ্রেপ্তার হতেহ পারেন বলে টের পেয়ে এখন গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে নুরুলের অবৈধ সম্পদের তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক মনিরুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নুরুলের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে ইতোমধ্যেই আদালতে আবেদন করা হয়েছে।’
সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কাগজে-কলমে নুরুল ইসলামের যে সম্পদের তথ্য আমরা পেয়েছি, বাস্তবে তার সম্পদ প্রায় তিন গুণ বেশি হবে।’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবা ব্যবসার টাকা বৈধ করতে মেসার্স আল নাহিন এন্টারপ্রাইজ, মিফতাহুল এন্টারপ্রাইজ ও আলফা এন্টারপ্রাইজ নামে কাগুজে আমদানি-রপ্তানি প্রতিষ্ঠান, নুরুল ও তার স্ত্রীর নামে মোট ১১টি ব্যাংক হিসাব খুঁজে পেয়েছে সিআইডি। এসব ব্যাংক হিসাবে ১৩ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য মিলেছে। এছাড়াও তার বাড়ি ও জমি থাকার তথ্য রয়েছে সিআইডির হাতে। এসব প্রতিষ্ঠান খুলে মাদকের টাকা বৈধ করার চেষ্টা করেন নুরুল।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক মনিরুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে আরও বলেন, মাদক, জাল টাকাসহ ঢাকার আদাবর এলাকা থেকে ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে র্যাব তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অনুসন্ধানের জন্য সিআইডিকে চিঠি দেয়। দীর্ঘ ১৫ মাস অনুসন্ধান করে সিআইডি ঢাকার মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় নুরুলের পাঁচটি বাড়িসহ ১৩ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে। মাদক মামলায় জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তিনি আর প্রকাশ্যে আসছেন না।
সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, নুরুল ইসলাম নিজ নামে এবং তার স্ত্রী ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঢাকার মোহাম্মদপুর, শ্যামলী ও টেকনাফে বিভিন্ন ব্যাংকে ১১টি অ্যাকাউন্ট থাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। মেসার্স আল নাহিন এন্টারপ্রাইজের নামে বেসরকারি একটি ব্যাংকের শ্যামলী শাখায় ২০১৭ সালে একটি হিসাব খোলা হয়। সেই হিসাবে ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত জমা হয়েছে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তুলে নেওয়া হয়েছে ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৮৫ টাকা। বর্তমানে ওই ব্যাংক হিসেবে ১ কোটি ৫ লাখ ১৫ টাকা স্থিতি রয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, মাদক ব্যবসার টাকায় গত ১০ বছরে ঢাকার মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় জায়গা কিনে পাঁচটি বাড়ি করেছেন নুরুল ও রাজিয়া দম্পতি। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের ৪ নম্বর রোডের ডি ব্লকে দুটি বাড়ি রয়েছে তাদের (বাড়ির নম্বর ৩৫ ও ৬৬)। একই এলাকার চন্দ্রিমা মডেল টাউনের ৭ নম্বর রোডের বি ব্লকের ১০ নম্বর বাড়িটিও তাদের। আদাবর নবীনগর হাউজিং এলাকার ৮ নম্বর রোডের ৬৮/৭০ নম্বর আধা পাকা আরেকটি বাড়ি রয়েছে নুরুলের। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং সোসাইটির ৩ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়িটিও তাঁর। সাততলা এই বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন নুরুল।
সিআইডি বলছে, নুরুলের স্ত্রী রাজিয়ার নামে মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর মৌজায় ৩ ও ৭ দশমিক ৪৭ কাঠার দুটি প্লট, সাভারের আমিনবাজার এলাকায় ৫৩ শতাংশ জমি রয়েছে। এ ছাড়া রাজিয়ার নামে টেকনাফে প্রায় ২৩ শতাংশ জমি রয়েছে।
তবে নুরুলের বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর সিআইডি বলছে, মূলত অবৈধ সম্পদকে বৈধ হিসেবে দেখানোর জন্য ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।
সিআইডির পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী অর্জিত সম্পদের কোনো বৈধ কাগজপত্র দিতে পারেননি। অনুসন্ধানে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, মাদকের কারবার করে তারা এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন।’
মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে সোমবার নুরুল ও তার কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে দুটি বেসরকারি ব্যাংকের শ্যামলী শাখায় থাকা তিনটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করার আবেদন ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। আদালত ওই আবেদন গ্রহণ করেছেন। পরে সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত।’
সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘নুরুল ইসলামকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে তার বৈধ আয়ের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিকানাও দিতে পারেননি তিনি।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নুরুল ইসলামের আয়কর বিবরণীতে ২০০৯ সালে তার কোনো স্থাবর সম্পত্তি ছিল না। অস্থাবর সম্পত্তি বলতে ছিল সাড়ে আট লাখ টাকা। ১১ বছর পর তার আয়কর বিবরণীতে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি মিলে ৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫ হাজার ৬৩১ টাকা দেখানো হয়েছে। আর ২০২১ সালে তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানার সম্পদ দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩৬ হাজার ৫১ টাকা।
ঢাকা টাইমস