‘প্রকল্পে সম্পৃক্ত না থেকেও’ পাঁচ দেশে প্রশিক্ষণ ১৬ কর্মকর্তার, রাষ্ট্রের ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭২ টাকা ক্ষতি
বেগুনবাড়ি খালসহ হাতিরঝিল এলাকায় সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে কোনও সম্পৃক্ততা ছিল না তাদের। এরপরও চীন, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও নেদারল্যান্ডসে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সরকারের উচ্চপদস্থ ১৬ কর্মকর্তা। সরকারি আদেশ অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে পাঁচ ধাপে তারা এ সফর করেন। এতে রাষ্ট্রের ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭২ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এই প্রশিক্ষণের বিষয়টি প্রকল্প সমাপ্তকরণ প্রতিবেদনেও অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের দফতরের চূড়ান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
২০২২ সালের নভেম্বরে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই কর্মকর্তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রশাসনিক কাজে জড়িত এবং তারা কোনও কারিগরি জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তি নন। তাদের লব্ধ জ্ঞান প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কাজে লাগানোর সুযোগ নেই। ফলে এই ১৬ জন কর্মকর্তাকে বিদেশ প্রশিক্ষণ দেওয়াতে প্রকল্পের কোনও উপকার হয়নি।
কারা সফর করেছেন
চীন ও ভিয়েতনামে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা হলেন পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন যুগ্ম প্রধান মো. ছায়েদুল হক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ শামসুল আলম, নির্বাহী হাকিম সৌদিউল ইসলাম ভূইয়া, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সহকারী প্রধান অনিমেষ সৌম, প্রটোকল অফিসার মল্লিক মোহাম্মদ এনামুল হক। তাদের নামে ২০১২ সালের ২৮ জুন সরকারি আদেশ হয়।
একই তারিখের আরেকটি সরকারি আদেশ বলে চীন ও ভিয়েতনামে ভ্রমণ করেন পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান মো. মইনুল ইসলাম তিতাস ও সহকারী প্রধান আবু বকর মো. তওহীদ, সঙ্গে ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. আকরামুজ্জামান।
তৃতীয় ধাপে ১৭ জুলাই ২০১৩ সালে চীন ও ভিয়েতনাম সফরের সরকারি আদেশ হয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আবু মাসুদ ও মন্ত্রীর সহকারী ব্যক্তিগত সচিব মো আসাদুজ্জামান, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদের জন্য।
চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরের জন্য ১৬ মার্চ, ২০১৬ তারিখে সরকারি আদেশ দেওয়া হয় বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের শেখ নজরুল ইসলাম, পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান এসএম গোলাম আলীর নামে।
শেষ ধাপে নেদারল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়া সফর করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মাহামুদুল হক, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের যুগ্ম সচিব ফাহিমুল ইসলাম ও পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান এএইএম কামরুজ্জামান।
নিরীক্ষায় যা পাওয়া গেলো
কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের দফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্প পরিচালক, বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল এলাকায় সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষাকালে দেখা যায়, প্রকল্প সমাপ্তকরণ প্রতিবেদনে প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত না থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন ১৬ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ায় কর্তৃপক্ষের ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭২ টাকা অপচয় করা হয়েছে।
নিরীক্ষাকালে পিসিআর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রকল্পে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রশিক্ষণের সমর্থনে যে সরকারি আদেশের কপি দেওয়া হয়েছে তা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মোট ৩৬ জন কর্মকর্তা বিদেশ প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। এরমধ্যে ১৬ জন কর্মকর্তা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে সম্পৃক্ত নন।
এতে আরও বলা হয়, অনিয়মের বিষয়ে ১১ নভেম্বর ২০২০ সালে সচিব বরাবর নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং ১৮ মার্চ ২০২১ তারিখে তাগিদপত্র ইস্যু করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনও নিষ্পত্তিমূলক জবাব পাওয়া যায়নি।
নিরীক্ষার সুপারিশে সরকারি টাকা অপচয় করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আপত্তিকৃত ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭২ টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা করা আবশ্যক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ কী বলছে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের সব অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এ বিষয়টি আমার জানা নেই। ফাইল দেখে বলতে পারবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘অডিট যদি কারও ব্যক্তিগত দায় দায়িত্ব নির্ধারণ করে, যদি এমন হয় যারা গেছিল তারা অন্যায়ভাবে গেছিল, তাহলে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। সেক্ষেত্রে দায়ীদের কাছে চিঠি লেখা হবে। যেহেতু সরকারি কর্মকর্তা, সেহেতু সরকারের একটা কোড আছে। যত টাকা পাওয়া যাবে ওই কোডে জমা দিতে হবে।’
তিনি জানান, কেউ অবসরে গেলেও তাকে দায়বদ্ধ করার সুযোগ আছে, যেহেতু তিনি পেনশন পান।
ক্ষমতার অপব্যবহার
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এখানে অনিয়ম হয়েছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এটা খুব অবাক করা বিষয় নয়। এটা এখন একটা বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যে বিদেশে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং এতে অংশগ্রহণ করবে, যাদের সঙ্গে প্রকল্পের সংশ্লিষ্টতা থাকুক বা না থাকুক, তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিদেশে যাবেনই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে অর্থ আদায় করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। কারণ, এখানে ক্ষমতার অপব্যহার করা হয়েছে। নিজেদের সুবিধার্থে করা কাজটিকে অনিয়ম চিহ্নিত করতে হবে। তাদের শাস্তি দিলে এটা একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হবে, যাতে পরবর্তীতে এরকম ঘটনা প্রতিরোধ করা যায়। এটা একটা অনৈতিক কাজ, অগ্রহণযোগ্য কাজ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’