আমার এক লেখক সখার ইনবক্সে একজন লিখেছে- ‘পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন অনৈসলামিক। আপনি এটা উদ্যাপন করছেন কেনো?’ ভাবলাম বৈশাখ নিয়ে আজকের লিখাটা এখান থেকেই শুরু করি। আমাদের পরিচয় কী হবে এবিষয়ক বিতর্ক একটা সহনীয় পর্যায়ে নিষ্পত্তি না হলে আমরা জাতি হিসেবে যে আগাতে পারব না, এটা তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। যে কোনো বিষয়ে বিরোধ-বিতর্ক সমাজের সুস্থতার লক্ষণ। কিন্তু আমাদের সব বিতর্ক আর বিরোধ অন্যমতকে নির্মূল করার প্রচেষ্টায় পর্যবসিত হয়। আমাদের সব হুঙ্কারই অন্যকে নির্মূল করার হুঙ্কার, আমাদের সব কমিটিই ‘নির্মূল কমিটি’। আমার লেখক সখার ইনবক্সে আসা চিঠির বিপরীতে আরেকটা নজির উল্লেখ করতে চাই। কিছুদিন আগে ৭১ টিভিতে আমার খুবই প্রিয় একজন শিল্পী ঢালাও হারে বোরকা পরাকে সমালোচনা করতে গিয়ে এটাকে অবাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে ‘বাতিলের খাতায়’ ফেলে দিয়েছেন। এই দুই বিপরীত মেরুর চিন্তার মাঝে আমি বিশেষ পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি না। বরং মিল খুঁজে পাচ্ছি। সেটা হচ্ছে সহনশীলতা আর উদারতার ব্যাপক ফারাক। আমাদের পরিচয়ের সূত্রগুলো মোটামুটি এই দুই দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। প্রথমে দেখি, আমাদের প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদীদের ‘পরিচয়ের ধারাপাত’য়ে কি লেখা আছে। ছোটবেলায় সংস্কৃতিচর্চার উদ্দেশে নাখালপাড়া থেকে ‘দুই পা বাহিরে ফেলিয়া’ শাহবাগ অঞ্চলে পৌঁছে অনেক ভালো ভালো ধারণার
সঙ্গে কিছু অদ্ভুত ধারণাও পেলাম। শাহবাগের আড্ডা, টিএসসি, আজিজ মার্কেট- এই রাস্তা-ঘাট ইট-পাথর সবই ছিল আমার শ্রেণী-শিক্ষক। শাহবাগের কাছে আমার তাই আজন্মের ঋণ। তো সেখানে গিয়েই আবিষ্কার করলাম সংস্কৃতিকর্মীরা পুজোয় যাবে, বড়দিনে যাবে, পুজো নিয়ে গল্প করবে, ভাই-ফোঁটা দিবে, কিন্তু শবেবরাতে তাদের কোনো কর্মসূচি থাকবে না। তারা ঈদের জামাত নিয়ে বেশি বাক্যব্যয় করবে না। আমার কেন যেন মনে হতো ইসলামী আচার বা সংস্কৃতি নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য না করাটাই প্রগতিশীল প্রমাণ করার উপায়। এই যে এভাবে আমার পরিচয় থেকে ধর্মীয় উপাদানকে তাড়ানোর চেষ্টা করল আমাদের প্রগতিশীল শিবিরের একটা বড় অংশ, এটা কি আদৌ এই জাতির বিকাশে কোনো সাহায্য করেছে? নাকি এ জাতিকে ভগ্নাংশেই পরিণত করেছে কেবল? একইভাবে আমাদের ধর্মীয় শিবির থেকে যেভাবে আমাদের জাতীয় চিহ্ন, উৎসব বা পরিচয়ের উপাদানকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা ইসলাম ধর্মের কোনো উপকারে এসেছে অহেতুক বিতর্ক বাড়ানো ছাড়া? এর উত্তর আমি জানি না। আসলেই জানি না। আমি কোনো ইসলামী পণ্ডিত হিসেবে নিজেকে দাবি করি না। কিন্তু ইসলাম ধর্ম বিষয়ে যতদূর পড়াশোনা বা জানার চেষ্টা করেছি, তা থেকে এটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি ইসলাম অনেক ইনক্লুসিভ (ভালো বাংলা প্রতিশব্দ পেলাম না) একটা ধর্ম। হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন ইসলাম প্রচার শুরু করলেন, তখন আরব ভূখণ্ডে চালু পূর্বতন সব ধর্মগ্রন্থকেই স্বীকৃতি দিয়ে নিলেন। পূর্বতন নবীদেরও শ্রদ্ধার জায়গায় বসালেন। আরব সংস্কৃতির নানা আচার এবং রীতির সমন্বয় ঘটালেন ইসলামী সংস্কৃতির নানা আচার এবং রীতিতে। এমনকি যারা ইসলামে ইমান আনেনি, তাদের প্রতিও তার উদারতা, সহানুভূতি আর ভালোবাসা ছিল নজিরবিহীন। নবীজির পথে কাঁটা বিছানো সেই বৃদ্ধার ঘটনা তো আমরা সবাই জানি। এরকম একটা ধর্মের অনুসারী হয়ে আমরা যখন বিয়োজনমূলক আচরণ করি, তখন সত্যিই বিস্ময় জাগে। যে রকম বিস্ময় জাগে আমাদের প্রগতিশীলদের আচরণে। পহেলা বৈশাখ আমার ভূখণ্ডের উৎসব। ইসলাম আরব দেশ থেকে এসে আজকে আমাদের এক বড় জনগোষ্ঠীর আচারের, জীবনযাপনের একটা অংশ হয়ে গেছে। আমার পরিচয়ের দুই সূত্র বিনা বিরোধে আমার মধ্যে একসঙ্গে বসবাস করতে পারে, করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই দুইয়ের মাঝে বিরোধ লাগিয়ে কে কোন ফায়দা উঠায়, সেটা আমি জানি না। কিন্তু আমি এটা জানি, আমার দুই পা’য়ের মাঝে ‘কাজিয়া’ চললে আমার চলাচলটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ‘এইরকম কাজিয়া-প্রবণ চেতনা লইয়া আমরা কি করিব।’