ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্রমেই বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। এসব অপরাধীদের প্রথম পছন্দ মাদক। আর মাদকের টাকা জোগাড় করতে বেছে নেয় ছিনতাইয়ের মতো জঘন্য কাজ। গত কয়েকদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় ঘটেছে বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা। এসব এলাকা ছাড়াও প্রতিটা হলের ছাদে রাতের বেলা বসে মাদকের আড্ডা। শাহবাগ থানার তথ্যমতে শুধু জানুয়ারি মাসেই এসব এলাকায় ঘটে যাওয়া ১৩ টি ছিনতাইয়ের অভিযোগ জমা পড়ে।
গত সোমবার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় দম্পতিকে মারধর, ২২ হাজার টাকা ছিনতাই ও এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগে ২ জনের নাম উল্লেখপূর্বক ১৪ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। মামলার আসামিরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের মাঝে দুইজন হচ্ছেন ঢাবির মাস্টার দ্য সূর্যসেন হলের ইতিহাস বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী ফাহিম তাজওয়ার জয় ও তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের একই বর্ষের শিক্ষার্থী সাজিদ আহমেদ। তারা দু›জনই হল শাখা ছাত্রলীগের সদস্য বলে পরিচিত। মাস্টারদা সূর্যসেন হলের প্রিন্সিপাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মো. আব্দুল মোতালেব বাদী হয়ে সোমবার এ মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ভুক্তভোগী দম্পতিকে শহীদ মিনার এলাকায় জয়-সাজিদসহ আরও ১০ থেকে ১২ জন অশালীন ভাষায় গালাগাল, শ্লীলতাহানি ও মারধর করে। এ সময় তাঁদের থেকে ২২ হাজার টাকা ও এটিএম কার্ড ছিনতাই করে। খবর পেয়ে মামলার বাদী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে সেখানে মারধর করা হয়।
একই দিনে (সোমবার) চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোটরসাইকেল আটকে নারীকে হেনস্তা, স্বামীকে মারধর ও ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দামের স্বর্ণলুট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বহিষ্কৃতরা হলেন-কবি জসীমউদ্দিন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৭-২০১৮ সেশনের শিক্ষার্থী তানজীর আরাফাত তুষার এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাবেক সদস্য আইন বিভাগের ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রাহুল রায়।
এর আগে গত রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশীতে ঘটে যায় আরেক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। একটি কাভার্ডভ্যান আটকিয়ে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে না পেয়ে ১৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালানোর সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী। পরে ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতের মাধ্যমে তাদের হাজতে পাঠায় শাহবাগ থানা পুলিশ।
গ্রেফতারকৃত তিন শিক্ষার্থী হলেন- থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের ফজলে নাবিদ সাকিল, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মো. রাহাত রহমান ও সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাদিক আহাম্মদ। তারা তিনজনই ২০২১-২২ সেশনের অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী বলে পরিচিত।
এভাবেই দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অপরাধ করে যাচ্ছে। যাতে কোনো ক্লান্তি নেই। আর প্রত্যেকটি অপরাধীর শিক্ষার্থী পরিচয়ের বাইরে মিলছে আরেক পরিচয় ; ছাত্রলীগ নেতা/ কর্মী। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের শাস্তি হচ্ছে আবার অনেক ক্ষেত্রেই মিলছে রেহাই।
ছিনতাইয়ের এসব ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব ঘটনায় জড়িত অধিকাংশ অপরাধীই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত গণরুমগুলোতে অবস্থান করে এবং ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় এসব অপরাধ করে থাকে।
মেধাবী শিক্ষার্থীরা কী কারণে অপরাধের পথ বেছে নেয় জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা আসেন তাদের অধিকাংশই প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয় আসার পর নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য তাদের নতুন সঙ্গ দরকার হয়। আর এ সঙ্গ হিসেবে তারা পায় কিছু ছেলেদের, যাদের মাথার উপর ছাদ হিসেবে রয়েছে পলিটিকাল গডফাদাররা এবং তাঁদের ছত্রছায়ায় এরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অপরাধে মেতে উঠে। তারা যখন দেখে টিউশনি কিংবা অন্যান্য জবের চেয়ে এই পথটা (ছিনতাই) অনেক সহজ এবং এতে পার পাওয়া যায় তখন এটাকেই তারা অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে।
প্রফেসর মাহবুব বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সিস্টেম চলে আসছে, যেখানে কাগজে কলমে একটা প্রশাসনিক বডি থাকলেও কার্যত ক্ষমতার অধিকারী ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন। তাই এসব অপরাধ থেকে উত্তরণ তখনই সম্ভব হবে যখন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে, আইনের শাসন থাকবে; গণতন্ত্র থাকবে। তা না হলে ৫০ বছর ধরে চলে আসা নৈরাজ্য কোনোদিনও বন্ধ হবে না।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, অপরাধী হওয়ার জন্য বয়সটা ফ্যাক্টর না। বরং এখানে মানবিক শিক্ষা এবং নৈতিক ভিত্তিটাই গুরুত্বপূর্ণ। এরকম মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছে এগুলা কেউ আশা করেনা। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউকে ছোটবেলা থেকে তৈরি করে আনি না। তারা একটা ভিন্ন পরিবেশে তৈরি হয়ে আসে। তারপরও এরকম একটি সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেও কারো ভিতরে যদি এরকম মন-মানসিকতা তৈরি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আমাদের যতটুকু করণীয় আছে আমরা তা করছি। আমাদের কাউন্সিলিং আছে, সাপোর্ট সেন্টার আছে, আর্থিক সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে, অ্যালামনাই কাজ করতেছে, শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন কারো কোনো সমস্যা থাকলে সেটা আমাদের সাথে শেয়ার করবে। সেজন্য তার বিভাগ আছে, স্টুডেন্ট এডভাইজার আছে, ক্লাসের শিক্ষক আছে, হল প্রশাসন আছে। এতকিছুর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে কেউ একটা অপরাধ করবে এটা জাতিও প্রত্যাশা করে না, আমরাও করি না।