তৃণমূলে প্রাণ নেই আওয়ামীলীগের

0

awami-league-flag-311x186১৪ দলীয় জোটের নেতৃত্বাধীন প্রধান শরিক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ (তৃতীয়) টানা বারবার সরকার গঠন করলেও তৃণমূলকে শক্তিশালী করে সাংগঠনিক ভিত মজবুত করতে পারেনি। সরকারে থাকা এ দলটি সবসময় দলীয় ফোরামের কার্যনির্বাহী কিংবা সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তৃণমূলকে শক্তিশালি করার কথা বলে আসছে। কিন্তু এ কাজটি এখন সম্ভব করতে না পারলেও কার্যত সরকারেই ব্যস্ত আওয়ামী লীগ। দলটির শীর্ষনেতাকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরাও ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে। এ কারণে দলটি এখন প্রশাসন নির্ভর হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, অনেক চাপ প্রয়োগের পর দলের ৭৩ সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ১৪টিতে সম্মেলন হয়েছে। বাদবাকি জেলাগুলোর অধিকাংশই ভারপ্রাপ্ত আর আহ্বায়কদের দিয়ে চলছে বছরের পর বছর। অনেক জায়গায় মৃত ব্যক্তিও আছেন কমিটিতে। নিজেদের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহে জড়িয়ে পড়ছেন নেতারা। নিজের মতো প্রভাব বলয় গড়ে তুলেছেন অনেক শীর্ষ নেতাও। দলে মূল্যায়ন পাচ্ছেন না সাবেক ছাত্র ও যুবনেতারা। তৈরি হচ্ছে না নতুন নেতৃত্ব। কর্মী ও সমর্থকরা নেতাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এসব কারণে বাংলাদেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ এ দলটির জনপ্রিয়তায় চিড় ধরেছে বলে মন্তব্য খোদ দলের নেতাকর্মীদেরই।

তাদের মতে, এসবের ফলে লাভবান হচ্ছে বিরোধী দল ও জোট। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন এলাকার জনপ্রিয় নেতাদের নিজেদের করে নিচ্ছে তারা। যার প্রতিফলন চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেখা গেছে। বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে বা দল সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও। এ নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত তিন বছরে আওয়ামী লীগের প্রায় প্রতিটি কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে তৃণমূল সম্মেলনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এসব সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ ৫ এপ্রিল কার্যনির্বাহী সংসদের এক বৈঠকে এ নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে তৃণমূল নিয়ে নেতাদের দ্বিধা বিভক্তির বিষয়টিও উঠে এসেছে। এ বিষয়ে দলের প্রধান নেতাদের সতর্ক করেন এবং সাংগঠনিক কোনো বিষয়ে দ্বন্দ্ব ফুটে উঠলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।

সম্মেলন নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের এ গড়িমসির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেক নেতাদের সাথে একান্ত আলাপে বেরিয়ে এসেছে, তৃণমূলে অনেক নেতাই দীর্ঘ একযুগ বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে আপন প্রভাব বলয় গড়ে তুলেছেন। যার জন্য কেন্দ্রীয় নেতা বা সাংগঠনিক সম্পাদকদেরও পাত্তা দিচ্ছেন না তারা। অনেক জায়গায় কেন্দ্র এবং স্থানীয় নেতাদের গ্রুপিং ও দ্বন্দ্ব এতো চরমে যে, সম্মেলন হলেই সংঘর্ষের আশঙ্কা আছে। ব্যক্তি ইমেজ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে বিষয়টির সুরাহা করতে নারাজ দলের হাইকমান্ড। এ বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কোনো সুফল পাননি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। তাই ‘রিস্ক’ নিতে চাচ্ছেন না তারাও।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ১৪টিতে কাউন্সিল হয়েছে। প্রায় ৫০০টি উপজেলা ও থানা কমিটির মধ্যে শ’দুয়েক কমিটির কাউন্সিল হয়েছে। অন্তত ২০ জেলায় এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। ১৫ জেলা কমিটির সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক পদে ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে চালানো হচ্ছে। তিনটি জেলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দু’টি পদেই আছেন ভারপ্রাপ্ত। আটটি জেলায় কাউন্সিল হয় না ১৬ বছর ধরে। ঢাকা মহানগর কমিটির সম্মেলন হলেও নতুন কমিটি নেই।

আওয়ামী লীগের বর্তমান জেলা শাখা কমিটিগুলোর বেশিরভাগেরই সম্মেলন হয়েছে ২০০৬ সালের আগে। এর মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জেলা কিশোরগঞ্জ, পটুয়াখালী, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা জেলায় (উত্তর ও দক্ষিণ) সম্মেলন হয় ১৯৯৭ সালে। তবে কুমিল্লা জেলার দক্ষিণ অংশ এখন চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। এছাড়া ১৯৯৭ সালে ঢাকার নাভি হিসেবে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জেলার কমিটি হলেও ২০০২ সালে একটি আহ্বায়ক কমিটি করে দেওয়া হয়। আহ্বায়ক এস এম আকরাম চলে গেছেন অন্য দলে আর যুগ্ম আহ্বায়ক মফিজুল ইসলাম মারা গেছেন দুই মাস আগে।

২০০০ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার সম্মেলন হয়। ২০০৩ সালে লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, রাজবাড়ী, জামালপুর, শরীয়তপুর, কুষ্টিয়া, পঞ্চগড়ে, পিরোজপুর ও হবিগঞ্জ জেলার সম্মেলন হয়। ২০০৪ সালে নোয়াখালী, নরসিংদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা জেলা, মহানগর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, যশোর ও নেত্রকোনার সম্মেলন হয়েছে। ২০০৫ সালে ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, জয়পুরহাট, বগুড়া, পাবনা, নওগাঁ, রাজশাহী মহানগর, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, শেরপুর, গাজীপুর, বরগুনা ও ভোলা জেলায় সম্মেলন হয়। ২০০৬ সালে ঝালকাঠি, মাদারীপুর, নড়াইল, মৌলভীবাজার জেলায় সম্মেলন করা হয়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছরের কমিটির মেয়াদ থাকলেও এসব জেলার ওই মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি বিহীন নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগ মারখাওয়া তৃণমূলকে চাঁঙ্গা করতে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানা গেছে। এরই অংশ হিসেবে আজকালের মধ্যেই আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতারা সাংগঠনিক দূর্বলতা কাটাতে মাঠে নামতে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, “বিএনপি-জামায়াতের সরকার বিরোধী অপপ্রচারের কাউন্টার এবং সরকারের সফলতা তুলে ধরার পাশাপাশি তৃণমূলকে আরো শক্তিশালি করা হচ্ছে।” তিনি বলেন, “সহিসংতা ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে জনগণের জানমালের ক্ষতি ঠেকাতে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ।”

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত পরিবর্তনকে বলেন, “নির্বাচন পরবর্তী যে কয়েকটি কাজে প্রাধান্য দেয়া হবে তার মধ্যে দলের তৃণমূলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা। কেননা দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা থাকলে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করা এবং আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা যাবে না।”

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিনপরিবর্তনকে জানান, “তৃণমূল সম্মেলন হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। আমরা তো একটার পর একটা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছি।” তিনি বলেন, “সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এখনই তো আর সম্মেলনের চাপ দেওয়া যায় না।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “সরকারে থেকে সংগঠনকে যথাযথ সময় দেওয়া কঠিন। ক্ষমতায় থাকলে সংগঠনকে প্রত্যাশা অনুযায়ী সময় দেওয়া যায় না। যার জন্য তৃণমূলের দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য ইতোমধ্যেই আমরা কাজ করছি। আশা করি, সমাধান হয়ে যাবে।”

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More