ভারতে হিন্দুত্ববাদী বজরং দলের সমর্থক ফেসবুক পেজে পিস্তল বিক্রির অভিযোগ

0

ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বজরং দলের সমর্থক কয়েকটি ফেসবুক পেজ থেকে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করার অভিযোগ ওঠেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বিষয়টি নিয়ে খোঁজ করার পরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির ওই পোস্টগুলি সরিয়ে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক একজন সাংবাদিক বিবিসি বাংলাকে অস্ত্র বিক্রির ওই বিজ্ঞাপনী ছবির স্ক্রিনশট পাঠিয়েছেন। বজরং দল যে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের যুব শাখা, সেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ জানিয়েছে যে তাদের সংগঠন কখনই অবৈধভাবে অস্ত্র বিক্রি বা সংগ্রহের পরামর্শ দেয় না।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাদের প্রতিবেদনে যে সাংবাদিকের কথা উল্লেখ করেছে, সেই রাকিব হামিদ নায়েক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি প্রথম লক্ষ্য করেন যে বজরং দলের সমর্থক একটি ফেসবুক পেজে পিস্তল আর দেশি পিস্তল, যাকে চলতি কথায় কাট্টা বলা হয়, সেগুলি বিক্রি করতে চেয়ে এক ব্যক্তি পোস্ট করেছেন।

এর পর তিনি এবিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির কাজ করতে শুরু করেন।

ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখেন সাংবাদিক রাকিব হামিদ নায়েক। এসংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইটও পরিচালনা করেন তিনি।



৫টি ফেসবুক পেজে অস্ত্র বিক্রির পোস্ট

“প্রথমে আমি ভেবেছিলাম যে ওটা একটা বিচ্ছিন্ন পোস্ট। কিন্তু তারপরে আমি বজরং দলের সমর্থক আরও কয়েকটি পেজে একই ধরনের পোস্ট লক্ষ্য করি। তখনই বিষয়টা নিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করি। বেশিরভাগ পোস্টেই পিস্তল বা কাট্টার ছবিসহ হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেওয়া হয়েছে যাতে আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেন। একটি পোস্টে আমি দেখেছি যে পিস্তলের দাম কত সেটাও জানতে চেয়েছেন গ্রুপের অন্য এক সদস্য,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. নায়েক।

হিন্দুত্ববাদী বজরং দলের সমর্থক পাঁচটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে তিনি মোট আটটি অস্ত্র বিক্রির পোস্ট দেখতে পান। এই গ্রুপগুলির কোনোটা পাবলিক গ্রুপ, কোনোটা ক্লোজড গ্রুপ।

রাকিব হামিদ নায়েক বলছিলেন, “একজন অস্ত্র বিক্রেতার সঙ্গে আমি ক্রেতা সেজে হোয়াটসঅ্যাপে আলাপও করেছিলাম এটা জানতে যে ওই বিজ্ঞাপনগুলো ভুয়া কি না। তাকে যখন আমি জিজ্ঞাসা করি যে ‘জিনিসটা’ পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে কি না, ওই বিক্রেতা জবাব দেন তিনি অনেক জায়গায় ‘জিনিস’ পাঠিয়েছেন, যার মধ্যে রাজস্থান আর হরিয়ানার ফরিদাবাদের কথা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন। এবং এটাও বলেন যে তিনি বজরং দলকেও ‘জিনিস’ দিয়েছেন।“

মি. নায়েকের ব্যাখ্যা ‘জিনিস’ বলতে ওই পোস্টগুলিতে পিস্তল আর দেশী কাট্টা বোঝানো হয়েছে। একটা দেশি পিস্তলের জন্য তার কাছে ১১ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল।



রাকিব হামিদ নায়েক ক্রেতা সেজে যোগাযোগ করেন এক অস্ত্র বিক্রেতার সঙ্গে

বজরং দলের সঙ্গে পেজগুলির সম্পর্ক কী?

মি. নায়েকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে তিনি কী করে নিশ্চিত হচ্ছেন যে ওই ফেসবুক গ্রুপগুলি আসলেই বজরং দলের সমর্থক?

“প্রথমত গ্রুপগুলির নামে স্পষ্টই লেখা আছে বজরং দলের কথা। আর সেখানে যা যা পোস্ট হয়, আমি দীর্ঘদিন ধরে সেগুলোর ওপরে নজর রাখি। তাই এটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয় নি যে গ্রুপের সদস্যরা বজরং দলের সমর্থক। তবে এটাও স্পষ্ট করে বলা দরকার যে এগুলোর কোনোটাই কিন্তু বজরং দলের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ নয়। সেজন্যই বারবার বলছি এরা বজরং দলের সমর্থক, এবং কেউ কেউ বজরং দলের পদাধিকারীও,” বলছিলেন রাকিব হামিদ নায়েক।

গ্রুপগুলির ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে এবছরের জানুয়ারি মাসে মি. নায়েক বিষয়টি ফেসবুকের নজরে আনেন। তিনি বলেন তখন তাকে জানানো হয় যে ওইসব পোস্ট ফেসবুকের নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।

এরপরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল যখন এবিষয়ে ফেসবুকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তারপরে গত মঙ্গলবার পোস্টগুলি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে লিখেছে সংবাদপত্রটি।

তারা ফেসবুকের এক মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলেছে “আমাদের অ্যাপে কোনও ব্যক্তিকে অস্ত্র কেনা বা বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয় না।“ কিন্তু ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এই প্রশ্নের উত্তর ফেসবুক কর্তৃপক্ষ দেয় নি যে আগে তাদের নজরে আনা হলেও তখনই কেন পোস্টগুলি তারা সরিয়ে দেয় নি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও প্রাক্তন কমান্ডো দীপাঞ্জন চক্রবর্তী বলছেন, “আমরা তো দেখেছি ফেসবুকে একটু অন্য সুরে কোন কথা পোস্ট করলেই অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয় তারা। আর অবৈধভাবে অস্ত্র কেনা বেচার পোস্ট এতদিন ধরে রয়েছে তাদের প্ল্যাটফর্মে কেউ নজর করল না! ভারতে ফেসবুকের যে মনিটরিং টিম রয়েছে তারা কী করছিল এতদিন ধরে?”

‘অবৈধ অস্ত্র কেনা বেচা কখনই সমর্থন করি না’

বজরং দলের মূল সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বলছে তারা জানে না যে কারা ওইসব গ্রুপ চালায়, কিন্তু এধরনের অবৈধ অস্ত্র কেনা-বেচা তারা কোনও মতেই সমর্থন করে না।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের মুখপাত্র শরদ শর্মা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমরা হিন্দুদের আত্মরক্ষার প্রয়োজনের কথা বলি ঠিকই, কিন্তু তা কখনই এভাবে অবৈধ পথে কেনা আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে নয়। বজরং দলকে আমরা পিস্তল বন্দুক ব্যবহারের কোনও পরামর্শ দিই না। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং কখনই আমরা এটাকে সমর্থন করব না।“

যখন মি. শর্মাকে বলা হয় যে বজরং দলের নাম ব্যবহার করে তৈরি করা ফেসবুক পেজে যে, তার কথামতোই, বেআইনি কাজ চলছে, তখন তিনি বলেন, “ওইসব ফেসবুক পেজ কারা বানিয়েছে তা জানা নেই। ওগুলোর সঙ্গে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরং দলের কোনও সম্পর্ক নেই।“

নিরাপত্তা বিশ্লেষক দীপাঞ্জন চক্রবর্তী বলছেন, “বজরং দল যে তাদের অফিসিয়াল পেজ থেকে এসব করবে না, এটা খুব স্বাভাবিক। তবে ওই পোস্টগুলো দেখে মনে হচ্ছে যে হিন্দুত্ববাদীরা একটা হাওয়া তুলতে চাইছে যে দেখ, হিন্দুদের হাতেও এখন আগ্নেয়াস্ত্র আছে বা তারাও দরকারে পিস্তল বন্দুক ব্যবহার করবে।

“মনে হচ্ছে হিন্দুত্বের সপক্ষে প্রচারের জন্যই এসব পোস্ট খুব সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে, না হলে দেশি পিস্তল বা কাট্টার জন্য কেউ ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয় না। ওসব অস্ত্র যাদের দরকার তারা ঠিকই জানে কোথায় গেলে তা পাওয়া যাবে।“

ফেসবুক এর আগেও ভারতে সমালোচনার মুখে পড়েছে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের উস্কানিমূলক এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর পোস্ট এবং ভিডিও না সরানোর অভিযোগে।

উৎসঃ   বিবিসি বাংলা
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More