আকিব থেকে সাকিব: চমেকে দুর্ধর্ষ ছাত্রলীগ

0

আইসিইউয়ের বেডে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে এক তরুণ। মাথার ধবধবে সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ লেখার নিচে এঁকে দেওয়া হয়েছে একটা বিপজ্জনক চিহ্নও। এমনই একটা ছবি ২০২১ সালে ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভাইরাল ছবিটি ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাহাদি জে আকিবের।

২০২১ সালের অক্টোবরে চমেক শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এমন পরিণতি হয়েছিল তার। এই ঘটনার জেরে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল চমেক কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার হয়েছিলেন জড়িত ৩০ জন। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের পরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি চমেক ছাত্রলীগ কর্মীদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সে সময় জড়িতদের বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিলেও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।

জানা গেছে, মেডিকেল কলেজটির ছাত্রলীগ কর্মীরা এখনও দুটি গ্রুপে সক্রিয়। এদের মধ্যে এক পক্ষ নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের ও অপর পক্ষ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী পক্ষটি ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে করতো। এদিকে, মহিবুল হাসান চৌধুরী শিক্ষা উপমন্ত্রী হওয়ার পর ২০২০ সাল থেকে তার অনুসারী পরিচয়ে আরেকটি ধারার সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে ক্যাম্পাসে একাধিকবার সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগের পক্ষ দুটি। ২০২০ এবং ২০২১ সালে অন্তত ১৫ বার সংঘর্ষে জড়ায় তারা। দুই গ্রুপের সংঘর্ষ সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নেয় ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর। সংঘর্ষে মহিবুলপন্থী কর্মী আকিবের মাথার খুলির হাড় ভেঙে যায়।

মাঝে কিছুদিন গ্রুপ দুটি প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে না জড়ালেও চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি আবারও সংঘর্ষে জড়ায়। তাদের সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের পর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে নগরের নাছিরাবাদে অবস্থিত চমেক প্রথম বর্ষের দুটি ছাত্রাবাস। সর্বশেষ গত ৮ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ বর্ষের চার ছাত্র— সাকিব হোসেন, জাহিদ হোসেন ওয়াকিল, আবু রাইয়াত ও মোবাশ্বির হোসেনকে প্রধান ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে নিয়ে পেটান ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তাঁদের মধ্যে সাকিব এবং ওয়াকিল এখন চমেক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এ ঘটনায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, রাজনীতিতে যুক্ত শিক্ষার্থীদের নিয়ে হাসাহাসি করায় ঘটনার সূত্রপাত হয়। এর জেরে বুধবার রাত দেড়টার দিকে ৬২তম ব্যাচের চার শিক্ষার্থী এম এ রায়হান, মোবাশ্বির হোসেন শুভ্র, জাহিদ হোসাইন ওয়াকিল ও সাকিব হোসেনকে রিয়াজুল ইসলাম জয়ের 17A রুমে নিয়ে যায়।

‘‘ওই রুমে সকাল পর্যন্ত ইব্রাহিম সাকিব, অভিজিৎ দাশ, রিয়াজুল জয়, জাকির হোসেন সায়াল, জুলফিকার মোহাম্মদ শোয়েব ও মাহিন আহম্মেদ তাদের নির্যাতন করেন। পরবর্তীতে বৃহস্পতিবার সকালে তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে তাদের ভর্তি নেয়নি, প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হলে ফেরত পাঠানো হয়।’’

ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের চুপ থাকতে হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে নির্যাতনের সংবাদ পেয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে হলে পুলিশ আসে। সাকিব এবং ওয়াকিলের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় পুলিশ ও কলেজ প্রশাসন তাদের হাসপাতালে ভর্তি করায়। বর্তমানে তারা চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

চমেক ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীরা জানান, যে ছয়জন সাকিব, ওয়কিলসহ চার শিক্ষার্থীকে মারধর করেছেন তারা ২০২১ সালে আকিবের ওপর হওয়া হামলাতেও জড়িত ছিলেন। এমনকি সংঘর্ষে জড়িত থাকায় তাদের মধ্যে রিয়াজুল ইসলাম জয় ও অভিজিৎ দাসকে দেড় বছর এবং মাহিন আহম্মেদ, জাকির হোসেন সায়াল, জুলফিকার মোহাম্মদ শোয়েব ও সাজু দাশকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ।

তবে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হলেও ছাত্রলীগের পরিচয় ব্যবহার করে এখনও প্রকাশ্যেই বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছেন এই অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা।

এদিকে, ২০২১ সালে আকিবের ওপর হামলার ঘটনার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও নীরব ছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল পদে পরিবর্তন এলেও চমেকের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান পূর্বের মতই। রোববার প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শৃংখলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া ৩০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও চমেকের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, চমেকে কিছুদিন আগে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনায় যাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

চমেকের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে চমেক অধ্যক্ষ সাহেনা আক্তার জানান, ছাত্রাবাসকে ঘিরে যে সকল অভিযোগ উঠেছে এগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উৎসঃ   দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More