ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়: একটি বিশ্লেষণ

0

ড. মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম

পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ পাক ইসলামের বিজয়ের পূর্বাভাস দিয়েছেন। চূড়ান্ত পূর্বাভাস দিয়েছেন সূরা নসর নাযিলের মধ্য দিয়ে। আল্লাহ পাক ঘোষণা দিলেনঃ “যখন আল্লাহর সাহায্য এসে যায় এবং বিজয় লাভ হয় আর (হে নবী) তুমি যদি দেখ লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করছে, তখন তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে ‘তাসবীহ’ পড়ো এবং তার কাছে মাগফিরাত চাও। নিশ্চয়ই তিনি বড়ই তওবা কবুলকারী (সূরা নসর)।” এ সূরা নাযিলের পর আনন্দ ও বেদনার সংমিশ্রণ ঘটে সাহাবাদের হৃদয়পটে। একদিকে ত্যাগ ও কুরবানীর মহাসগর পেরিয়ে বিজয়ের আগমনবার্তা, অন্যদিকে মহানবী (সাঃ) এর ইহধামের ইঙ্গিত। সুবিজ্ঞ অনেক সাহাবীর মনে মোঁচড় দিয়ে উঠলো এক অজানা বিয়োগ ব্যথা, অশ্রুর বন্যায় ভেসে গেল অনেকের বপুদেশ। সূরা নসরের ঘোষিত বিজয়বার্তা আসলে কি ধরণের ছিলো, কিভাবে এলো এ মহাবিজয়- এ বিষয়গুলো এ নিবন্ধে আলোকপাত করা হবে ইনশাল্লাহ।

বিজয়, নাকি বিদায়?

অনেকে মনে করেন সূরা নসর হলো মক্কা বিজয়ের আগাম ঘোষণা। কিন্তু আসলে তা নয়। কারণ মক্কা বিজয় হয় ৮ হিজরীতে, আর সূরা নসর নাযিল হয় ১০ হিজরীর শেষের দিকে। হযরত ইবনে ওমরের মতে বিদায় হজ্বের সময় আইয়ামে তাশরীকের মাঝামাঝি সময় মিনায় নাযিল হয় সূরা নসর। বিজয়ের সাথে সাথে চূড়ান্ত বিদায়ের পূর্বাভাস পেয়ে যান বিশ্বনবী (সাঃ)। সূরাটি নাযিলের পর বিদায় হজ্বের ভাষণ দেন তিনি।

মক্কা বিজয়ের পর মহানবীর মনে আশা জাগলো হজ্ব করার। হিজরতের পর এমন সুযোগ আর হয়নি। বিপুল আয়োজনের ঘোষণা দেয়া হলো যাতে কোন সাহাবীই এ মহা সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত না হয়। হযরত আলী (রাঃ) কে ইয়েমেন থেকে ডেকে আনা হলো। মহল্লায় মহল্লায় প্রচার চালানো হলো লোক প্রেরণ করে। উম্মুল মুমেনীন সবাইকে সঙ্গে চলার পরামর্শ দেয়া হলো। হযরত ফাতেমাকে সঙ্গে চলার নির্দেশ দেওয়া হলো। ২৫ জিলকদ মসজিদে নববীতে জুম্মার নামায আদায় করা হলো, আর ঘোষণা দেওয়া হলো পরদিন (২৬ জিলকদ) রওয়ানার। খুশির রেণু ছড়িয়ে পড়লো সকলের অন্তরে। মহানবী গোসল করলেন। সুন্দর পোশকে সজ্জিত হলেন। হযরত আয়েশা নিজ হাতে আতর মাখিয়ে দিলেন। এরপর দু’রাকাত কাতরভাবে নামায আদায় করলেন মহানবী। নামায শেষে সওয়ারীতে আরোহণপূর্বক এহরাম বাঁধা সমাপ্ত করলেন। সবার মুখে মুখে ধ্বনিত হলো লাব্বাইকা ধ্বনি। আল্লাহর মহীমা কীর্তনে আকাশ-বাতাস ভরে উঠলো। পাহাড় প্রান্তর তাওহীদের তারাণায় মুখরিত হতে লাগলো। হযরত জাবের (রাঃ) বলেনঃ সেদিন যে পর্যন্ত দৃষ্টি যায় কেবল মানুষেই দেখা যায়। যখন রাসূল (সাঃ) এর উট কোন টিলার উপর আরোহণ করতো, তখন তিনি তিনবার উচ্চকন্ঠে তাকবীর ধ্বনি করতেন। সঙ্গে সঙ্গে তা অগণিত কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়ে এই পবিত্র কাফেলার মধ্যে যেন আল্লাহর মহীমা কীর্তনের প্লাবন বয়ে যেত। নয় দিন চললো এ যাত্রা।

জিলহজ্ব মাসের চার তারিখে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মক্কার ঘরবাড়ী দেখা যাচ্ছিল। হাশেমী খান্দানের ছোট ছোট শিশুরা মহান স্বজনের আগমনবার্তা শুনে ছুটে বের হয়ে এলো। সবার পবিত্র মুখে মধুর হাসি প্রস্ফুটিত হলো। রাসূল (সাঃ) আরোহণ হতে ঝুঁকে কাউকে উটের অগ্রে, কাউকে উটের পশ্চাতে বসাতে লাগলেন। এক সময় চোখে পড়লো পবিত্র খানায়ে কাবায়। রাসূল (সাঃ) বলতে লাগলেন- “আয় আল্লাহ। কাবার মর্যাদা আরো বাড়িয়ে দাও”। কাবাঘর তাওয়াফ করলেন। মাকামে ইব্রাহীমে গমন করে শোকরানা নামাযা আদায় করলেন। কাবাঘর চোখে পড়লে জলদ্গম্ভীর স্বরে তাকবীর ও তাওহীদের কলেমা উচ্চারিত হতে লাগলো। “আল্লাহ এবং আল্লাহই একমাত্র উপাস্য। তার কোন শরীক নেই। সমস্ত রাজ্য তার। প্রশংসা তাঁরই জন্য। তিনি জীবন দান করেন, তিনিই মৃত্যু ঘটান। তিনি সকল কিছুর উপর শক্তিমান। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন। তিনি তার বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি একাই সকল আক্রমণকারীকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন”।

মিনাতে অবস্থান করলেন ৮ জিলহজ্ব। ৯ জিলহজ্ব ফজরের নামায শেষ করে ‘ওয়দিয়ে নোমরা’ নামক স্থানে বিশ্রাম নিলেন। দিনের শেষভাগ কাটালেন আরাফাতের ময়দানে। সে ময়দানে এক লাখ চব্বিশ হাজার (মতান্তরে ১ লাখ ৪৪ হাজার) আল্লাহর প্রেমিকের তাকবির ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হচ্ছিলো। রাসূল (সাঃ) একটি উটে আরোহণ করে প্রভাতী সূর্যের ন্যায় পর্বত চূড়ায় উদিত হলেন। পর্বত প্রান্তরে অবস্থান করছিলেন হযরত আয়েশা, সাফিয়া, ফাতেমা, আলী, খালেদ, বেলাল, সমস্ত আসহাবে সাফফাহ, আশারা মুবাশশারাহ ও হাজার হাজার উম্মত। দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন ‘উম্মতের অভিভাবক তার উম্মতকে প্রাণভরে দেখে নিচ্ছেন এবং বিদায়ের প্রাক্কালে সর্ব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। শুরু করলেন শেষ খুৎবা। উম্মতের জন্য শেষ অশ্রুবিন্দু এই খুৎবায় পুঞ্জীভূত হয়।

সে সময় রাজ্য ও সম্পদ মুসলমানদের দিকে প্লাবনের মত আসছিলো। মহানবীর ভয় এই সম্পদে প্রাচূর্য তাদের ঐক্যবন্ধন ছিন্ন করবে। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন। দূর্বল শ্রেণীকে অভিযোগ করার সুযোগ দিওনা যেন ইসলামের এই প্রাচীরে কোনরকম ফাটল সৃষ্টি হতে না পারে। শেষ অসিওত করলেনঃ এই বাণী যেন পরবর্তী উম্মতের জন্য প্রচারের সুব্যবস্থা করা হয়। খুৎবা শেষে দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য উপস্থিত লোকেদের নিকট হতে সাক্ষ্য গ্রহণ করত: আল্লাহকে এমন ভাবে ডাকতে শুরু করলেন যে, উপস্থিত সকলের অন্তর গলে গেলো। চক্ষু ফেটে অশ্রুর বন্যা প্রবাহিত হলো। দেহের পিঞ্জরে আত্না যেন ছটফট করে শান্তির জন্য কাতর স্বরে চিৎকার করে উঠলো। আল্লাহর মহীমা কীর্তনের পর খুৎবার সর্বপ্রথম মর্মস্পর্শী কথা ছিলোঃ “লোক সকল। আমার ধারণা যে, আজকের পর আমি এবং তোমরা এরূপ জামায়াতে আর কখনো একত্রিত হবো না।” সবার অন্তর কেঁপে উঠলো। হারানোর অসহ্য অজানা ব্যথা সবাইকে বিমূঢ় করে দিলো। আসল কথা শুরু করলেন মহানবী (সাঃ) “লোক সকল। তোমাদের রক্ত সম্পদ এবং মান সম্মান পরষ্পরের নিকট এতটুকুই পবিত্র যতটুকু আজকের এই (জুম্মার) দিন, আজকের এই (জিলহজ্ব) মাস এবং এই (মক্কা) শহর পবিত্র”। লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে আরো একটু জোর দিয়ে বললেনঃ “লোক সকল। শেষ পর্যন্ত একদিন না একদিন তোমাদেরকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে হবে। সেখানে তোমাদের কৃতকর্মের হিসাব করা হবে। আমার পর ভ্রান্ত হয়ে একে অপরের মস্তক ছেদন করতে শুরু করোনা। বেদনা বিধুর অসিওতের প্রতিটি কথা তার পবিত্র জবান হতে বের হয়ে শ্রোতাদের অন্তরে ছেদন করে গেলো। বলে গেলেনঃ আমি দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি তোমাদের জন্য। এগুলো তোমরা আঁকড়ে ধরলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। সেগুলো হলোঃ কুরআন ও সুন্নাহ”। স্বীয় দায়িত্বের ব্যাপারে সবার নিকট থেকে সাক্ষ্য গ্রহন করতঃ মহানবী তার শাহাদাত আঙ্গুল আকাশের দিকে তুলে এরপর লোকেদের দিকে ঝুকিয়ে তিনবার বলেনঃ “হে আল্লাহপাক তুমি সাক্ষী থেকো”। ভাষণ শেষ হলে আল্লাহপাক জানিয়ে দিলেন ইসলামে পূর্ণাঙ্গতার ঘোষণাঃ “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম” (সূরা মায়েদঃ ৩)। এটাই ছিলো ইসলামের পরিপূর্ণতা এবং চূড়ান্ত বিজয়ের ঘোষণা। জানা যায়, এরপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বেঁচে ছিলেন মাত্র তিনমাস কয়েকদিন।

কিসের বিজয়?

সূরা নসরে আল্লাহপাক কোন যুদ্ধ বিজয়ের কথা বলেননি, বরং ইঙ্গিত করেছেন এক চূড়ান্ত নৈতিক বিজয়ের। মক্কা বিজয় চূড়ান্ত বিজয় ছিলো না, কারণ এরপর তায়েফ ও হুনায়ূনের যুদ্ধ হয়। আরবের ইসলামে পূর্ণাঙ্গ প্রাধান্য পেতে আরো দুই বছর লেগে যায়। নবম হিজরীর শেষের দিকে দলে দলে লোক কোন চাপ ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলামের ছায়াতলে স্থান নেয়। এরপর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছালো যে, দশম হিজরী বিদায়হজ্বের সময় আরবে কোথাও কোন মুশরিক ছিলো না। মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে এলো ইসলামের এই চূড়ান্ত বিজয়। মহানবী এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে পুরো একটা জাতির আকিদা বিশ্বাস, চিন্তাধারা, আচার-আচরণ, নৈতিক চরিত্র, সভ্যতা-সংস্কৃতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, সামরিক যোগ্যতা সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছেন। এ চূড়ান্ত বিজয় ছিলোঃ

১. আল্লাহর সর্বভৌমত্বের বিজয়। সব ধরনের শিরক, পঙ্কিলতা, কলুষতাকে, পদদলিত করে এক আল্লাহর সর্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠার বিজয় ছিলো এটি।

২.এটি ছিলো বিশ্ব ইতিহাসের চূড়ান্ত নৈতিক বিজয়। যে আরব ছিলো অনাচার, অবিচার, হত্যা, লুন্ঠন, ব্যভিচারসহ সব ধরনের অসভ্যতার কেন্ত্রস্থল, সেই আরবভূমিতে মহানবী এমন এক নৈতিক বিপ্লব সাধন করলেন যে তার কর্মীবাহিনীর প্রত্যেকটা মানুষ পরিণত হলেন বিশ্বের সেরা মানুষে। আল্লাহর খেলাফত কায়েমপূর্বক তার সন্তুষ্টিই ছিলো তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। দুনিয়ার ঠুনকো চাওয়া-পাওয়াকে কিঞ্চিত পরোয়া করেনি তারা।

৩. মহানবী তেইশ বছরের মধ্যে উদ্ধার করলেন মুর্খতা ও অজ্ঞতার মধ্যে আপাদমস্তক ডুবে থাকা একটি জাতিকে। গড়ে তোলেন এমন যোগ্যতাসম্পন্ন রূপে, যার ফলে তারা সারা দুনিয়া জয় করে ফেলেছে এবং সমগ্র বিশ্বের জাতিসমূহের নেতৃত্বের পদে অসীন হয়েছেন। জোর করে নয়, বরং ভালোবসা, সুবিচার এবং ত্যাগের মহীমা দিয়ে জয় করে বিশ্ব মানবতার অন্তর। গড়ে তোলেন এক নৈতিক সভ্যতার ইমারত।

৪. বিশ্বমানবতার এই চূড়ান্ত নৈতিক বিজয় এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিলো যে বাদশাহ-ফকির, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো এদের মধ্যে কোথাও কোন পার্থক্য ছিলো না; ছিলো অন্য ভাইয়ের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা ও ত্যাগের মহাইতিহাস। এমন নৈতিক বিজয়, যেখানে তারা নিজে ক্ষুধার্থ থেকে অন্য ভাইকে খাওয়ানোর মধ্যে আনন্দ পেতেন, অন্যের দুঃখ কষ্টে যাদের বপুদেশ ভেসে যেতো এক অসহনীয় চাপা কান্নায়, সম্পদ অর্জনে নয় বরং সম্পদ বিলিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যাদের মধ্যে ছিলো প্রতিযোগিতা। যারা একসময় একে অপরের রক্ত পান করতো, তারাই দেখা গেলো জিহাদের ময়দানে আহত অবস্থায় তৃষ্ণায় কাতর থেকেও নিজে পানি না খেয়ে অপর ভাইকে বাঁচানোর জন্য পানি এগিয়ে দিয়েছে। এমন নৈতিক উৎকর্ষতা এবং মহাবিজয় বিশ্বজাহান কখনো দেখেনি। ঐতিহাসিক বসওয়ার্থ (Bosworth) ঠিকই বলেছেনঃ By fortune absolutely unique in the history, Prophet Muhammad is the three-fold founder of a nation, of an empire and of a religion. অর্থাৎ ‘ইতিহাসের এক চরম সৌভাগ্য এবং ইতিহাসে এটা একেবারেই বিরল যে, মহানবী একাই তিনটি বিষয়ের স্থপতি- একটি জাতি, একটি সাম্রাজ্য এবং একটি ধর্ম।

কিভাবে এলো এ বিজয়?

এক আল্লাহ তাআলার একচ্ছত্র ও সার্বভৌম প্রভুত্বের ভিত্তিতে মানব জীবনের পরিপূর্ণ ইমারত রচনা করার প্রচেষ্টা ও আন্দোলনকে বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে বলা হয় ইসলাম। রাসূলপাকের জীবদ্দশাতেই এ ইমারত পরিপূর্ণভাবে রচিত হয়েছিলো। কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব হলো? রাসুলপাকের জীবনের মহা আন্দোলনের বিশ্লেষণ করলে আমরা এক ত্রিমুখী বিপ্লবের সন্ধান পাইঃ

(ক) গ্রাসরুটস পর্যায়ের বিপ্লবঃ এটাকে “Down-Up Approach”ও বলতে পারি। ইসলামের অমীয়বাণী এবং মহাসাম্যনীতি সর্বপ্রথম আকৃষ্ট করলো সমাজের নির্যাতিত ও নিগৃত লোকেদেরকে। তাদের সমন্বয়েই মহানবী গড়ে তোলেন তাঁর কর্মীবাহিনীকে। এ বিপ্লব গ্রাসরুটস পর্যায়ের সকলকে তাদের চিন্তা-চেতনার ও কর্মপদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনলো এবং তারা যে কোন রকম চ্যলেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সদা প্রস্তুত ছিলো। গ্রাসরুটস পর্যায়ে মজবুত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়াই মক্কায় প্রথম ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মদীনার আপামর জনসাধারণের মধ্যে এ বিপ্লব ঘটেছিলো, আর তাঁর ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণে সহায়তা করেছে মক্কা থেকে হিযরত করে আসা রাসূলের পূর্ব প্রস্তুত সাহাবীগণ।

(খ) বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবঃ পবিত্র কোরআনের প্রত্যেকটা বাণীই যেন সমাজের সকল রসম-রেওয়াজ ভেঙ্গে চুরমার করে এক নব-বিপ্লব ঘটিয়েছিলো নব মুসলমানদের মধ্যে। পবিত্র কোরআনের ভাষা ও বচনভঙ্গি গর্বের সাথে লালন করা আরবের সকল সাহিত্যভান্ডারকে ম্লান করে দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের প্রত্যেকটা আয়াতই যেন ছিলো এক মহাবিপ্লবের ইঙ্গিত।

(গ) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাঃ মদীনাতে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্টিত হওয়ায় ইসলাম পূর্ণাঙ্গ রূপ পেলো। রাজনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে ইসলাম ইনসাফের ভিত্তিতে এক মহাবিপ্লব সাধন করলো। ইসলামের এই মহাসৌন্দর্য দেখে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লোক দলে দলে ভিড়তে লাগল ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। অন্যদিকে রাজশক্তির মজবুতির কারণে ইসলামের শত্রুরা একের পর এক পরাজয় বরণ করলো। সব মিলে এই বিশাল ইসলামী আন্দোলন এবং তাঁর চূড়ান্ত বিজয়কে আমরা কতগুলো পর্যায়ে ভাগ করতে পারিঃ

১. মহানবীর প্রথম দাওয়াত ছিলোঃ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন প্রভূশক্তিকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করো এবং একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব কবুল করো। তাগুতকে নির্মূল করো। এর কারণ হলো আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে প্রভূত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকারী মনে করার মারাত্নক বিষ যতদিন পর্যন্ত ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল থাকবে, ততদিন পর্যন্ত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে কোন সংশোধনের প্রচেষ্টা সফল হতে পারে না।

২. এ মহান এবং বিপ্লবী দাওয়াত পৌরহিত্যের উপর কঠিন আঘাত হানে এবং সমাজ ব্যবস্থার প্রত্যেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকে এক আসন্ন বিপদের ভয়াবহ আশংকা আতঙ্কিত ও ভীতি বিহ্বল করে তোলে।

৩. সমাজের অপেক্ষাকৃত নীচু শ্রেণীর লোকেরা এই দাওয়াত কবুল করে আর তারা ছিলো কঠিন প্রাচীরের ন্যায় মজবুত।

৪. একের পর এক বাঁধা আসা শুরু হলো। হিযরতের আগ পর্যন্ত আমরা দশ ধরনের পর্যায়ক্রমিক বাঁধার সন্ধান পাইঃ

(ক) উপেক্ষাঃ মহানবীর বিশ্বজনীন বিপ্লবী দাওয়াতকে প্রাথমিক পর্যায়ে সবাই উপেক্ষা করা শুরু করলো। অনেকেই এটাকে কোন পাত্তা বা আমল দিল না। সামাজিক কাঠামোতে মহানবীর এ দাওয়াত যে নতুন সংস্কারের ইঙ্গিত এটা তখনো সমাজপতিরা বুঝতে পারে নাই।

(খ) তর্কাতর্কিঃ যখন দু’একজন করে মহানবীর এই বিপ্লবী কাফেলায় শামিল হতে লাগলো, তখন সমাজের কিছু লোক মহানবীর সাথে তর্কে লিপ্ত হলো। কেন তিনি পিতার ধর্ম ছেড়ে নতুন কিছু প্রচার করছেন…ইত্যাদি।

(গ) উপহাস ও অপমানঃ নতুন ধর্ম প্রচারের বিষয়টি অনেকের কাছে উপহাসের বিষয় মনে হলো এবং রাস্তাঘাটে তারা বিভিন্ন সাহাবীদেরকে উপহাস ও অপমানের পাত্র বানালো।

(ঘ) গুজব ছড়ানোঃ অনেকে মহানবীর ব্যাপারে গুজব ছড়াতে লাগলো যে তিনি পাগল হয়ে গেছেন বা তাকে জীনে ধরেছে। অনেকে তাকে ‘পাগলা কবি’ হিসেবে খেতাব দিল (নাউজুবিল্লাহ)। এসবের উদ্দেশ্য ছিল মহানবী (সাঃ) থেকে সবাইকে দূরে রাখা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রচার হিতেবিপরীত হয়েছে।

(ঙ) সুযোগ সুবিধার ঘোষণাঃ কোন কিছুতেই যখন মহানবীকে তার মিশন থেকে নিবৃত্ত করা গেলো না, তখন কাফেররা তাকে বেশ কিছু সুযোগ- সুবিধার দানের ঘোষণা দিলো। সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ছিল নেতৃত্ব, অগাধ সম্পদ, সুন্দরী নারী এবং জীনের আছর থেকে মুক্তির চিকিৎসা। মহানবী (সাঃ) সাফ জানিনে দিলেনঃ এক হাতে চন্দ্র এবং অন্যহাতে সূর্য এনে দিলেও তিনি তাঁর কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নিবেন না। কাফেরদের এ চাল ব্যর্থ হলো।

(চ) হুশিয়ারী সংকেতঃ মহানবীকে মহাহুশিয়ারী সংকেত শোনানো হলো যে তিনি তার কাজ ত্যাগ না করলে তাকে হত্যা করা হবে।

(ছ) ক্ষতি সাধন ও ত্রাস সৃষ্টিঃ এরপর উটের ভুড়ি নামাযের সময় মহানবীর (সাঃ) মাথায় চাপা দিয়ে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা হলো। মহানবী ও সাহাবাদের উপর সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চললো।

(জ) দাবি: কোন কিছুতেই যখন কোন ফল দিলো না, তখন কফেররা মহানবীর কাছে অনেক উদ্ভট দাবী-দাওয়া পেশ করলো। যেমনঃ ফেরেশতাদেরকে ডেকে আন, তোমার আল্লাহকে দেখাও ইত্যাদি।

(ঝ) নিষেধাজ্ঞা ও সমাজচ্যুতিঃ শেষ পর্যন্ত আবু তালিবসহ মহানবী ও তার সঙ্গীসাথীদেরকে শো’বে আবু তালিব নামে এক নির্জন স্থানে নির্বাসন দেওয়া হয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর, সামাজিক অধিকার বঞ্চিত মহানবী ও তাঁর সাহাবীগণ কাটান টানা তিন বছর। পরপারে যাত্রা করেন মহানবী (সাঃ) এর মহা দুই সহায়ক ও রক্ষক তাঁর চাচা আবু তালিব ও স্ত্রী খাদিজা (রাঃ)।

(ঞ) হত্যার পরিকল্পনাঃ পরিশেষে মহানবীকে জনমের মত শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মক্কার কাফের সভাসদে, যার চূড়ান্ত পরিণতি মদীনায় হিজরত।

৫. কাফেরদের সাথে সংঘাত প্রচন্ড আকার ধারণ করলো। মুজাহিদদের কারো আয় বন্ধ হলো, কেউ বিতাড়িত হলো, কারোর আত্নীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হলো।

৬. পরীক্ষার পর পরীক্ষা এলো। সাহাবাগণ পরীক্ষার অগ্নিদহন সহ্য করে এমন নিখাদ স্বর্ণে পরিণত হলো যে, যে কোন পরীক্ষার কষ্টি পাথরে যাচাই করেও তাদের মধ্য থেকে সামান্যতম খাদও বের করা সম্ভব হলো না। এভাবে এমন এক বিপ্লবী কর্মীবাহিনী গড়ে উঠলো যারা আল্লাহকে ভয় করতো, দুনিয়ার লাভক্ষতির কিঞ্চিত পরোয়া করতো না তারা। এই বিপ্লবী আন্দোলনে ইসলামী মূলনীতি হতে এক ইঞ্চি বিচ্যুতিও তারা বরদাশত করেনি কখনোই।

৭. সত্যের সৈনিকরা যখন এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন, তখন তাদেরকে অটল অনড় ও অনমনীয় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবং সকল প্রকার প্রলোভন, বিপদ-আপদ, আশংকা ও আতঙ্ক তাদের সংকল্পের সম্মুখে প্রতিহত হতে দেখে সমগ্র দুনিয়া মহান বিষ্ময়ে অভিভূত হলো।

৮. দুর্বলচিত্তরা ভেগে গেলো এবং সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে যোগদান করলো।

৯. নামায ফরজ হলো। এর ফলে তাদের লক্ষ্য ও মানসিক ঝোঁক একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে এসে কেন্দ্রীভূত হলো।

১০. নতুন আগতদের ট্রেনিং দেয়া হলো। নৈতিকতার ক্ষেত্রে মহাবিপ্লব ঘটলো। অন্যদিকে দ্বন্দ-সংঘাতের ফলে ইসলামী আন্দোলন অধিকতর সম্প্রসারিত হলো।

১১. এভাবে ঘটে গেল পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে শাসনতন্ত্র ও শাসনপদ্ধতিই পরিবর্তন হলো না, বরং দেশের বিপুল জনগণের মনোভাব ও চিন্তাধারায় এলো আমূল পরিবর্তন। এটাই ছিলো ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়।

শেষ কথাঃ

সুদীর্ঘ ২৩ বছরের সীমাহীন ত্যাগ ও কোরবানীর বিনিময়ে আল্লাহ পাক দিলেন ইসলামের সুমহান বিজয়। বিশ্বনবীর এই সাফল্য বিশ্বকে করেছে হতবাক। এনসাইক্লোপেডিয়া অফ ব্রিটানিকা লেখেছে- “Of all religious personalities of the world, Muhammad is the best successfull” (দুনিয়ার সকল ধর্মগুরুর মধ্যে মুহম্মদ হলেন সবচেয়ে সার্থক)। কিন্তু এই বিশাল বিজয়েও ইতিহাসের পাতায় আমরা দেখি না কিঞ্চিত অহংকারের ছাপ, ছিল না কোন বিজয়ের উল্লাস, বাদ্য-বাজনা, ছিল না কোন কুচকাওয়াজ, কিংবা সপ্তাহব্যাপী ছুটি ঘোষণা; বরং ছিল মহানবীর নমনীয়তা, সেজদায় লুটে অশ্রু বিসর্জনের দৃশ্য, ছিল মহান আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা প্রার্থণার কাতর অবস্থা। কোন ধরণের অহংকারের পরিবর্তে মহানবী তাঁর হৃদয়ের সকল আবেগ আকুলতা নিয়ে বেদনাবিধুর আহাজারীতে অনুশোচনায় শঙ্কিত রিক্ত শূন্য বিদগ্ধ হৃদয়ে বিগত দিনের অজ্ঞানতা প্রসূত ভ্রান্তি এবং অক্ষমতার জন্য জীবনের শেষ দিনগুলোতে মহান আল্লাহ পাকের কাছে অশ্রুসজল নয়নে ক্ষমা চাইতেন। সকলকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিলেন বিশ্বজয়ী বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মহানবী (সাঃ)।

সহায়ক গ্রন্থঃ

১. মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী, তাফহিমূল কুরআন, ১৯শ খন্ড (ঢাকা)

২. Mohsin M. Saleh. Rise and Expansion of Islam (Kuala Lumpur)

৩. মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী, ইসলামী বিপ্লবের পথ (ঢাকা)

৪. আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, আর রাহীকুল মাকতুম (অনুবাদঃ খাদিজা আখতার রেজায়ী), আল কুরআন একাডেমী, লন্ডন।

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি, সিঙ্গাপুর

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More