বহাল তবিয়তে সিভিল এভিয়েশনের অসাধু কর্মকর্তারা

0

মানবপাচারে অভিযুক্ত এবং কোকেন পাচারের মামলার আসামি হওয়ার পরও সিভিল এভিয়েশনের অসাধু কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে রয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। অভিযোগ থাকার পরও তারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে বিমানবন্দরের বিভিন্ন সেকশনে। অভিযোগ তদন্তে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না সিভিল এভিয়েশনের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা। এসব ঘটনায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে সিভিল এভিয়েশনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। মানবপাচার বা কোকেন পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগের পরও বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় হুমকি হিসেবে দেখছেন এভিয়েশন সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালে রফতানি কার্গোতে সিকিউরিটি সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত সাইদুল হক ভূঁইয়াকে আসামি করা হয় কোকেন পাচারের মামলায়। সে সময় গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে সাইদুল হক ভূঁইয়াসহ সিভিল এভিয়েশনে কর্মরত ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলাটি এখনও চলমান। চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ। নিয়মিত মামলায় হাজিরাও দিচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে দুই জন অবসরে গেছেন। তারাও নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন।

সেই কোকেনপাচার মামলার একজন আসামি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সাইদুল হক ভূঁইয়ার প্রত্যক্ষ মদতে কোকেন পাচার হচ্ছিল। এ ঘটনায় তিনি দায়ী। আর ভুক্তভোগী হচ্ছি আমরা। আদালতে তারিখ পড়লে হাজিরা দিচ্ছি। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ছিল, কিন্তু সেদিন সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

কোকেনপাচার মামলা চলমান থাকার পরও সেই রফতানি কার্গো সেকশনে ডিউটি সিকিউরিটি অফিসার (ডিএসও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন সাইদুল হক ভূঁইয়া। ঘটনা ২০১২ সালের হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই এ বিষয়ে অবগত নন। তবে তারা বলছেন, মামলার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। কোন প্রক্রিয়ায় এখনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন আসামিরা—তা খতিয়ে দেখছেন ঊর্ধ্বতনরা।

মামলার বিষয়ে রফতানি কার্গো সেকশনের ডিএসও হিসেবে কর্মরত সাইদুল হক ভূঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোকেনপাচারের মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছি। মামলাটি চলমান রয়েছে।

মামলা চলমান থাকার পরও এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব পালন কীভাবে সম্ভব, এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে যান। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

এছাড়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাদের মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়গুলো উঠে এসেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। দুই বছর আগের প্রতিবেদনে মানবপাচারে সিভিল এভিয়েশন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি ওঠে এলেও সে ঘটনায় নেওয়া হয়নি কোনও ব্যবস্থা। নামমাত্র তদন্ত হয়েছে শুধু। সে তদন্তও আলোর মুখ দেখেনি।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তালিকায় মানবপাচারের অভিযোগে ৩৭ জনের নাম থাকলেও তাদের বিষয়ে নেওয়া হয়নি কোনও ব্যবস্থা। অভিযোগ থাকার পরও অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। নামমাত্র কয়েকজনকে সে সময় বদলি করা হয়। সেই মানবপাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বর্তমানে শিফট ইনচার্জ হিসেবে রফতানি কার্গোতে দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া, রফতানি কার্গো সেকশনে নিরাপত্তা অপারেটর (চলতি দায়িত্ব) জহিরুল হকের বিরুদ্ধে সবজির কুরিয়ারে টাকা পাচারের অভিযোগ থাকায় তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবার একই জায়গায় পদায়ন করা হয় তাকে। কার্গো সেকশনে অবৈধ কার্যকলাপ ও চাঁদাবাজির অভিযোগে কার্গো সেকশনের প্রাক্তন ম্যানেজার ও সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফখরুদ্দিন ভূঁইয়া অভিযুক্ত হয়। পরবর্তীতে সেই ম্যানেজারকে বদলি করা হলেও নিরাপত্তা সুপারভাইজার ফখরুদ্দিন ভূঁইয়া একই জায়গায় কর্মরত। বর্তমানে সাইদুল-জিন্নাহ সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য এই ফখরুদ্দিন—বলছেন কার্গো সেকশনে দায়িত্বরতরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মানবপাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (বর্তমানে রফতানি কার্গো সেকশনের শিফট ইনচার্জ), কোকেনপাচার মামলার আসামি সাইদুল হক ভূঁইয়া (বর্তমানে রফতানি কার্গো সেকশনের ডিএসও) রফতানি কার্গো সেকশনে নিজেদের সুবিধার জন্য পছন্দমতো লোকজন বাছাই করে সেখানে কাজ করাচ্ছেন। এই দুই জনের সহায়তায় কার্গো সেকশনের ইডিএস (এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম) মেশিনে কর্মরত নিরাপত্তা সুপারভাইজার মাসুদ করিম, নিরাপত্তা সুপারভাইজার বদরুল আলম, নিরাপত্তা সুপারভাইজার গোলাম মো. আজাদ ও নিরাপত্তা সুপারভাইজার ফখরুদ্দিন ভূঁইয়া, জহিরুল হকসহ (নিরাপত্তা অপারেটর চলতি দায়িত্ব) আরও কয়েকজন দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় কর্মরত রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযোগের ভিত্তিতে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও তাদের আবারও একই দায়িত্বে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন একই জায়গায় থাকায় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তারা। আর এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন সাইদুল হক ভূঁইয়া। তার সহায়ক হিসেবে কাজ করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কার্গো সেকশনে পণ্য ইউরোপসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর জন্য ডিএইচএল, ফেডেক্সসহ সব কুরিয়ার থেকে টনপ্রতি এক হাজার থেকে ১৫০০ টাকা করে আদায় করছে সিন্ডিকেট। ইডিএস মেশিনের মাধ্যমে স্ক্যানিং করা পণ্য ইউরোপে পাঠানো হয়। পাঠানো প্রতিটি পণ্যই এই মেশিনের মাধ্যমে স্ক্যানিং করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর এই সুযোগেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে, যা কার্গো সেকশনে ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, শিফট ইনচার্জ জিন্নাহর শিফটের কোনও পরিবর্তন নেই। প্রত্যেক রোস্টারে দেখা যায়—মাহবুব আলম নামের একজন সুপারভাইজার জিন্নাহর শিফটেই থাকেন। সব অনিয়ম জিন্নাহর মাধ্যমেই করা হয় বলে অভিযোগ করেন তারা। এই সিন্ডিকেটের হয়রানি ও নিয়ম এবং চাঁদাবাজির কারণে সঠিক সময় মালামাল পাঠাতে না পারায় অনেকে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। বিভিন্ন কুরিয়ারের সদস্যরা মালামাল পাঠাতে বাধ্য হয়ে তাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিচ্ছেন।

চাকরি যাবার ভয়ে এসব বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করেন না। ভুক্তভোগীরা আরও অভিযোগ করেন, অনেকেই হারিয়েছেন চাকরি, আবার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাদের সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে তাদের ম্যানেজ করা ছাড়া কোনোভাবেই পণ্য পাঠানো সম্ভব নয়।

মানবপাচারের অভিযোগ থাকার পরও রফতানি কার্গো সেকশনের শিফট ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত থাকার বিষয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মানবপাচারের অভিযোগের বিষয়ে ডিপার্টমেন্ট তদন্ত করেছে। তদন্ত শেষে কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা ডিপার্টমেন্টই জানে। আমি এখন রফতানি কার্গো সেকশনের শিফট ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত রয়েছি। আমরা কেউ ফেরেশতা নই, আমরাও মানুষ। এক জায়গায় চাকরি করলে সবাই বন্ধু হয় না।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রফতানি কার্গোতে অনিয়ম-হয়রানি এবং সিন্ডিকেটের বিষয়ে বেশ কয়েকটি অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। আমরা এসব বিষয় খতিয়ে দেখছি। এসব ঘটনায় কারও সম্পৃক্ততা থাকলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মানবপাচার ও কোকেন মামলার আসামিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এসব বিষয় আপনার কাছ থেকে অবগত হলাম। খতিয়ে দেখা হবে।

এসব নিয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সিভিল এভিয়েশনে কর্মরত যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আসে সেসব বিষয় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের প্রত্যাহার করা উচিত। তা না হলে তারা বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

উৎসঃ   বাংলা ট্রিবিউন
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More