মিনার রশিদ
“ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়?” ফেব্রুয়ারি মাস এলেই এই কিছিমের কিছু কথা আমাদের কানে ভেসে আসে। আমরা সবাই তখন অতি বাঙালি হয়ে পড়ি। বছরের একটি দিনে মা দিবস, বাবা দিবসের মত এটিও আমাদেরও বাঙালিপনা দেখানোর মাস। এরকম শুধু একটি নয়, কয়েকটি মাস কথিত এক চেতনার হাতে বিলকুল ইজারা দেওয়া হয়ে গেছে! ইজারাদারদের কথা বা অনুমোদন ছাড়া আপনি সামান্য নড়ন চড়নও করতে পারবেন না!
বুদ্ধিবৃত্তিক এই পাহলোয়ানদের জিজ্ঞেস করতে পারবেন না যে ১৯৫২ সালে তখনকার শাসকগোষ্ঠি জনগণের কন্ঠরোধে (মুখের ভাষা কাইড়া নিতে) যা করেছিল বর্তমান গোষ্ঠী কি তার চেয়ে কোনো অংশে কম করছে? ভাষার মাসেই দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হলো। চেতনার এই একই ইজারাদাররা একটা টু শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন না!
এরকম একটা আবেগ বা ধারণা নিয়ে একটা শতাব্দি পার করে দিলাম। এখনও একটু হুঁশে এসে জিজ্ঞাসা করি না যে ১৯৫২ সালে ভাষা নিয়ে আসলেই কী হয়েছিল?
এই বেহুঁশ অবস্থা যদি শুধু একটি নির্দোষ চেতনা বা আবেগজাত হতো তবে কোনো কথা ছিল না। এই চেতনার হাত ধরেই আজ আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-গণতন্ত্র-রাজনীতি-অর্থনীতি-রাষ্ট্র্ যন্ত্র সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে ! কাজেই এই হুঁশ ফেরানো অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে! জাতির এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে শত্রুরা আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে তাই করে যাচ্ছে!
ওরা কী আসলেই আমাদের মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চেয়েছিল? পাশের দেশ ইন্ডিয়াতে কোনো রাষ্ট্র ভাষা নেই। ইংরেজি ও হিন্দি অফিসিয়াল ভাষা এবং আরো দুই ডজনের কাছাকাছি সেমি অফিসিয়াল ভাষা রয়েছে। এখন যাদের (এর মধ্যে আমাদের অতি প্রিয় বাংলা ভাষাভাষী দাদা-দিদিরাও রয়েছেন) ভাষা ইন্ডিয়ার মূল অফিসিয়াল ভাষা হয় নাই,তারা কী মনে করছে যে তাদের মুখের ভাষা কাইড়া নেয়া হচ্ছে?
উপমহাদেশের সকলেই না হলেও বিরাট একটা অংশ হিন্দি বা উর্দু জানে বা বুঝে! হিন্দি আর উর্দু কাছাকাছি দুটি ভাষা। বলা যায় হিন্দিকে সামান্য বা হাল্কা মুসলমানি করিয়ে (কিছু আরবি/ফার্সি শব্দ ঢুকিয়ে) উর্দু বানানো হয়েছে! অনেক হিন্দি গান বলতে যা জানি তা মূলত উর্দুগান। পাঞ্জাব,সিন্ধ,বেলুচিস্তানের মানুষ কখনোই বাংলা ভাষায় কথা বলতে আগ্রহী হতো না! উপমহাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে যদি একটি ভাষাকে অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ করতে হয় তা হবে হিন্দি অথবা উর্দু। হিন্দির ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা মেনে নিলেও উর্দুর ক্ষেত্রে তা মানতে প্রস্তুত নই! ১৯৫২ সালে যত জোরে উর্দুকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, এখন তার চেয়েও বড় শক্তি দিয়ে হিন্দিকে কাছে টানছি!
থিক হেডেড বা মোটা মাথার পাকিস্তানের শাসকেরা (যার মধ্যে বাঙালিরাও ছিল) ভাষা নিয়ে এই গুবলেটটি পাকিয়েছিল! রাষ্ট্রভাষা না বলে অফিসিয়াল ভাষা বললে সম্ভবত এই জটিল পরিস্থিতিটির সৃষ্টি হতো না। কারণ মাল্টিল্যাংগুয়েজ একটি রাষ্ট্রে পারস্পরিক ভাব আদান প্রদানের জন্যে এরকম একটি কমন ভাষাকে অফিসিয়াল ভাষা করতে দোষের কিছু ছিল না।
বাংলাভাষা নিয়ে অতীব স্পর্শকাতর পশ্চিম বঙ্গের দাদা ও দিদিরা কিন্তু হিন্দির অপরিহার্যতা মেনে নিয়েছেন। এই দাদাদিদিরাই কিন্তু আমাদের এই আবেগে এখনও অত্যন্ত দরদমাখা আবেগ সিঞ্চন করে বাতাস করেন। যে কলকাতা শহরে এখন হিন্দির আধিপত্য দেখা যায় সেখান থেকেও বাঙালিরা এসে আমাদের মরমের এই জায়গাটিতে হাওয়া দিয়ে যান!
যে ম্যাজিষ্ট্রেট সেদিন সালাম,রফিক,বরকতের গায়ে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল এবং যে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল তারাও এই বঙ্গদেশের সুসন্তান ছিলেন! কেন আমরা তাদের চিহ্নিত করে রাখলাম না? আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা বলে যে এদের বংশধরেরা এখন শতভাগ চেতনাপন্থী হয়ে পড়েছে। এরাই এখন পাকিস্তান শব্দটি উচ্চারণ করলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করেন, সম্ভবতঃ পূর্ব পুরুষদের পাপ ঢাকতে!
১৯৫২ সালে এই বাংলাভাষী পুলিশের গুলিতে সর্বমোট পাঁচজন মারা গেলেও সঙ্গীতে গাচ্ছি,”ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এই ফেব্রুয়ারি”! এই দেশে নাকি “সব শালাই কবি হতে চায়”। অথচ ২৫শে ফেব্রুয়ারিতে এদেশের সাতান্ন জন আর্মি অফিসার (মাটির সূর্য সন্তান)অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হলেও এই “কবি শালা”দের কেউ তেমন আবেগমাখা একটা কবিতাও লিখলো না! যে কবিতার মাধ্যমে মনের সেই কষ্টটি সম্যক প্রকাশ করা যেতো! কবিতায় এই সব শালা, হারামজাদা, *মারানি শব্দগুলি শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে!
যাদের প্রতিবাদ করার কথা, সিংহের হুংকারে গর্জে উঠার কথা তাদের নীরবতা আজও জাতিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে! জানি না কখন আবার শোনবো ভাসানির সেই ‘খামোশ’ হুংকার! এই ইদুরের বাচ্চাদের আর কতদিন দেখতে হবে?
রং বেরংয়ের কানাঅলা এবং দিকহারা জাতি :
ভূত জগতের ট্রাফিক পুলিশ হলো কানাঅলা। জনবিরল জলাশয়ের পাশে কিংবা কোন উন্মুক্ত প্রান্তরে অবস্থান করে রাতের বেলায় পথিকদের দিগভ্রান্ত করে বা পথ ভুলিয়ে দেয়। কানাঅলা ধরলে সেই পথিকের পথ আর ফুরোয় না। বার বার চক্কর দিতে থাকে। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে পড়লে এক সময় সেই শিকারের ঘাড় মটকে দেয়।
এই ধরণের কানাঅলা ভূত সত্যি সত্যি আছে কি না জানি না তবে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও বিনোদন জগতে এই কানা অলা ভূতের অস্তিত্ব ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। এই কানা অলা ভূতদের অনেকেই জাতির পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। এই সুযোগে এরা জাতিকে নিয়ে মনের মত ফুটবল খেলে। আর এদের সম্মিলিত প্রয়াসেই জাতি বর্তমান দশায় পৌছে গেছে।
এই কানাঅলারা ভালোমন্দ মাপার জনগণের সেন্সরকে সত্যিই সত্যিই বিকল করে ফেলে। এখন আমরা ৩০ ডিগ্রী তাপমাত্রা এবং ৯০ ডিগ্রী তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। এক হাওয়া ভবনকে নিয়ে এই কানাঅলারা জাতিকে যতটুকু হাওয়ায় ভাসিয়েছে এখন হাজার হাজার জলভবন দেখেও জাতিকে জলবৎ ঠান্ডা বানিয়ে রেখেছে। দশ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর খরচ তিরিশ হাজার কোটি টাকা হয়ে গেলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই।
দেশ থেকে পনের বছরে ১৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে সেদিকে কোনো দৃষ্টি নেই। ইসলামি ব্যাংক থেকে এক লাখ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে এবং দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংকটিকে জয়বাংলা করেছে সেদিকে খেয়াল নেই। একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠায় জাতির এপর্যন্ত আর্থিক ক্ষতি কমপক্ষে ২৫০ বিলিয়ন ডলার বা ২৫ লাখ কোটি টাকা! যা ইচ্ছে লুটেপুটে খা, শুধু সরকারের বিরোধিতা করিস না-পলিটিকেল এই আস্কারায় জাতির এই আর্থিক ক্ষতিটি হয়েছে। ২০০৪/২০০৫ সালে এই দেশটিকে যে ইমার্জিং টাইগার বলা হয়েছিল এতদিনে কাছাকাছি জায়গায় পৌঁছে যেতাম। সাথে সাথে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও ম্যাচুরিটি চলে আসত। এই কানাঅলারা জাতির সেই মহাসর্বনাশটি করেছে!
এই কানাঅলা ভূতেরা আমাদেরকে ক্লান্ত, শ্রান্ত,দিগভ্রান্ত করে চূড়ান্তভাবে ঘাড়টি মটকানোর জন্যে। সেই ঘাড় মটকানোর কাজটি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে! এখন ‘ইন্ডিয়াকে যা দিয়েছি তা কোনোদিন ভুলতে পারবে না’ এই কথা প্রকাশ্যে বললেও কিছু করতে পারি না!
আঠার কোটি মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ঠিক নাই। এই কানাঅলা বারো ভূতেরা মিলে দেশটিকে লুটে পুটে খাচ্ছে। আদানির সাথে চুক্তিতে নাকি দেশ লাভবান হয়েছে, আরাফাত নামক এক বাচ্চা কানাঅলা ভূত এখনও তারস্বরে তা বলে যাচ্ছে। জাতিকে ব্যস্ত করে ফেলা হয়েছে না না চেতনার শরবত খাইয়ে! কানাঅলারা আমাদেরকে ডিজিটাল বানিয়ে ফেলেছে। এখন ইস্মার্ট বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে! বলদা জাতিরেই এই কিছিমে ইস্মার্ট বানানো সম্ভব!
এর শুরুটি আমাদের জন্মের পর পরই। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক পাক বাহিনীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে হেলিকপ্টারযোগে রওনা দিলেন। পথিমধ্যে তার হেলিকপ্টারকে গুলি করে ভূপাতিত করা হলো। কানা অলা ভূত শিখিয়ে দিল কাদেরকে এই কাজের জন্যে সন্দেহ করতে হবে। আমরাও তাই করলাম। কিন্তু এমএজি ওসমানীর হলিকপ্টারটি কে বা কারা গুলি করে ভূ-পাতিত করল, সেই রহস্য উদঘাটনে ব্রেইনের এক বাইটও খরচ করি নাই। এরকম জলজ্যান্ত কাহিনী নিয়ে কেউ একটি সিনেমা বানানোর কথা কল্পনাও করে নাই ।
মাথায় টুপি এবং মুখে দাঁড়ি সমেত রাজাকারদের নিয়ে হাজার হাজার নাটক ও সিনেমা বানানো হয়েছে। এসব নিয়ে অনেক গোয়েন্দা কাহিনী রচিত হয়েছে। এখানেও কানাঅলারা আমাদের পথ দেখিয়েছে। কোনোরূপ প্রশ্ন না করেই সেই পথে আমরা হেঁটেছি এবং এখনও পরম তৃপ্তিভরে হাঁটছি। অদৃশ্য কানাঅলা একটু আড়ালে থাকলেও কিছু দৃশ্যমান কানাঅলা নানা মুখরোচক নামে মাঠে নামানো হয়েছে।
১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি জহির রায়হান কেন নিখোঁজ হলেন এবং তার দায়ও কেন রাজাকারদের ঘাড়ে চাপল (সে সময় এরকম হিম্মৎ কি তাদের আসলেই ছিল?) সেই ঘটনা নিয়েও কোনো অনুসন্ধান করলাম না। দৃশ্য অদৃশ্য কানাঅলারা কিছু বয়ান তৈরি করে আমাদের মুখে ধরিয়ে দিলেন! গত ৫০ বছর ধরে টিয়া পাখির মত সেটাই আমরা আওড়াচ্ছি! কেউ তেমন জোড়েশোরে পাল্টা প্রশ্ন করছি না। এই ঘটনার বেনেফিশিয়ারীকে খুঁজতে এখনও সাহস করছি না!
বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আমরা যে একটা বলদা জাতি (কম আইকিউ সম্পন্ন) আমাদের শত্রুরা সেই তখন থেকেই বিষয়টি মাল্মু করে ফেলেছে! ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ডের পর পর পাশের দেশের প্রাক্তন সেনা প্রধান একটি আর্টিকেল লেখেন। পিলখানা ট্রাজেডির পেছনের মূল খেলারামকে জাতি যাতে চিনে না ফেলে তজ্জন্যে এই কানাঅলা শ্রেষ্ঠ দয়াপরবেশ হয়ে আমাদেরকে মূল ক্রিমিনাল (পাকিস্তানের আইএসআই এবং তাদের দালালদের?) চেনাতে এগিয়ে আসেন । শংকর রায় চৌধুরীর সেই আর্টিকেলটির শিরোনাম ছিল, Delhi can’t afford to let Dhaka slip off its radar.
তার পুরো লেখাটাই ছিল, ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই না – এর মত! মূলত: ঢাকাকে দিল্লির রাডারের আওতায় রাখতে সেটাই ছিল তাদের অন্যতম অপারেশন! তবে বুদ্ধু জাতি যাতে কখনও তাদের চেহারাটা চিনতে না পারে তজ্জন্যে এই শংকর রায় চৌধুরীরা গত অর্ধ শতাব্দি ধরেই নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কানাঅলার এই কাজটি করে যাচ্ছে।
জানি না, আর কত ২৫ শে ফেব্রুয়ারি লাগবে নাবালক এই জাতিকে সাবালক বানাতে!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, লেখক ও গবেষক।