সময় তখন আনুমানিক পৌনে পাঁচটা। অন্য সময়ের মতই যানজটে ঠাসা গুলিস্তানের সড়ক। বাস-রিকশার পাশাপাশি প্রাইভেটকার ও ঠেলাগাড়ি গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এসময় হঠাৎ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সবকিছু, ধোঁয়ায় কয়েক হাত দূরেও জিনিসও দৃষ্টিসামীর বাইরে চলে যায়।
মঙ্গলবার বিকালে বিকট সেই শব্দের ঘোর কাটতে না কাটতেই উবারের গাড়ি চালক আনোয়ার হোসেন দেখলেন, তার গাড়ির উপর উড়ে এসে পড়েছেন পায়জামা পাঞ্জাবি পরা এক লোক; ভেতর থেকে দেখলেন লোকটার মাথা দিয়ে রক্ত ঝড়ছে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আনোয়ারের ভাবনায় খেলে গেল মাথার উপর কোনো ভবন বুঝি ধসে পড়েছে। এ আতঙ্কে ওই অবস্থায় কিছুদূর চালিয়ে এসে সড়কের একপাশে থামালেন গাড়ি।
পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারের নর্থ সাউথ রোডে মঙ্গলবার বিকালে সাত তলা ভবনে বিকট বিস্ফোরণের পর কিছু অংশ ধসে পড়ার সময় আশেপাশে উপস্থিত আনোয়ারের মত অনেকই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন; চারিদিক ধুলোয় ঢেকে যাওয়ায় অজানা আতঙ্ক পেয়ে বসেছিল তাদের মধ্যে।
বিস্ফোরণে ভবনটির দেয়াল ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি ভেতরের জিনিসপত্র ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ভাঙা টুকরোর আঘাতে আহত হয়েছেন পথচারী ও আশেপাশের মানুষ।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, একটি বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যাতে কেঁপে উঠেছিল চারদিক। এরপর গাঢ় ধোয়ায় ভরে গিয়েছিল পুরো এলাকা। হঠাৎ কুয়াশার মত আবছা অবস্থা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
সেসময় বিআরবি কেবলসের কর্মী মোঃ মেজবাহ ওই পথ ধরে তখন আছরের নামাজের জন্য পাশের মসজিদে যাচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে চারিদিক। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না কিছুক্ষণ। কী ঘটছে সেই আতঙ্কের মধ্যেই দেখেন ফুটপাতে, রাস্তায় পড়ে আছেন অনেক লোক, রক্তাক্ত। কেউ চিৎকার করছেন, কেউ নিথর।
নর্থ সাউথ রোডে সেসময় চলমান একটি বাসের ওপরও ভবনের ধসে পড়া অংশ এসে ছিটকে পড়ে। সাভার পরিবহনের ওই বাসের অনেক যাত্রী আহত হন। বাসটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি কাঁচও অবশিষ্ট ছিল না।
এসময় রিকশা, গাড়ির যাত্রী ও চালকরাও ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে ভবনের ভাঙা টুকরোর আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে পড়েন।
পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে মঙ্গলবার একটি ভবনে বিস্ফোরণের পর হতাহতদের বের করে নিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। |asif mahmud ove
হুড়মুড় করে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয় এসব ব্যক্তির। বাস ও গাড়ি থেকে নেমে আসছেন মাথায় হাত দিয়ে। অনেকেরই কপাল পেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। কারও জামা কাপড় ছেঁড়া, কারও কারও শরীরে ছিন্নভিন্ন কাপড় উড়েই গেছে।
এ অবস্থায় সেখানে থাকা যারাই সুযোগ পেয়েছেন তারা আহতদের ভ্যানে তুলে হাসপাতালে পাঠান।
স্থানীয় বাসিন্দা গাজী আতাউর রহমান বলছেন, বিস্ফোরণের সময় তিনি আরেকটি মার্কেটে ছিলেন। ভবন কেঁপে ওঠার পর আতঙ্কে রাস্তায় নেমে দেখেন অনেক লোক কাতরাচ্ছে। কারও শরীরের কাপড় পুড়ে গেছে, কারও চামড়া উঠে গেছে।
পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে মঙ্গলবার একটি ভবনে বিস্ফোরণে আহত একজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী ও স্থানীয়রা। |asif mahmud ove
ভয়াবহ এ ঘটনায় ঘটনাস্থলে ও হাসপাতালে নেওয়ার পর অন্তত ১৬ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অনেকেই।
স্থানীয় বেকারি ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ বলছেন, শবে বরাতের ছুটিতে গ্রামে যেতে অনেকে আশপাশের বাস কাউন্টারগুলোতে আসছিলেন। তাদের দোকানেও রুটি কিনছিলেন কেউ কেউ। বিকট সেই বিস্ফোরণে সবাই হচকচিয়ে যান। ভবন থেকে মানুষ ছিটকে রাস্তায় পড়তে দেখেন তিনিও।
ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের পাশাপাশি সড়কে থাকা বাস ও রিকশার যাত্রী-চালকরাও আহত হয়েছেন।
‘মানুষ উড়ে এসে পড়েছিল রাস্তায়, গাড়ির ওপরও’
নূর মোহাম্মদসহ সেখানে থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, তখন ওই ভবনের সামনে যারা ছিলেন তারা সবাই কমবেশি আহত হয়েছেন। এরপর স্থানীয়রা জড়ো হয়ে তাদের রিকশা, ভ্যান, সিএনজিতে করে হাসপাতালে পাঠায়।
রায়হান নামে এক তরুণ জানান, তিনি পাশেই একটি রেস্তোরাঁয় খেতে বসেছিলেন। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে বের হয়ে এসে দেখেন রাস্তাটার পুরোটা ধ্বংসস্তূপ হয়ে রয়েছে। এখানে সেখানে মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে কাতরাচ্ছে। ভবনটির সামনে একটি রিকশায় দুই তরুণী আরোহী ও রিকশাচালক নিথর অবস্থায় পড়ে রয়েছেন।
কী ছিল সেই ভবনে
স্থানীয় শফিউদ্দিন ভূঁইয়া সেন্টু বলছেন, যে মার্কেটে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেটিকে স্থানীয়রা ক্যাফে কুইন সেনেটারি মার্কেট হিসেবেই চেনে।
ভবনটির ওপরে সাত তলা এবং নিচে ভূগর্ভস্থ আরও একটি তালা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভূর্গভস্থ তালায় মূলত দুটি প্রতিষ্ঠানের শোরুম ও গুদাম। ভবনের ওপরের তলায় চার ভাইয়ের আবাসিক ফ্ল্যাট রয়েছে। এর পাশেই ব্র্যাক ব্যাংকের ভবনটি।
ফায়ার সার্ভিসের একজন ফায়ারম্যান জানান, ভবনটির আন্ডারগ্রাউন্ডে সেপটিক ট্যাংক ছিল। সেখানে বিস্ফোরণের আলামত আছে। গ্রাউন্ড ফ্লোর ও দোতলার ফ্লোর ধসে পড়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলছেন, ওই ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে বেঁচে থাকা মানুষজনের নাড়াচড়া তারা জানতে পেরেছেন। এখন সেখানে ভেঙে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, এ বিস্ফোরণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এত বড় বিস্ফোরণ আর ঘটেনি।