শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম নিজের জীবন ও সম্পদহানি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে আজ হোক কাল হোক পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, এটা আমি জানি। নিয়ে যাক, আমার সুষ্ঠু বিচার হোক, আমিও চাই। কিন্তু আমাকে যেদিন নিয়ে যাবে, তার পরদিন দেখবেন আমার জীবনের অর্ধেক নেই। কারণ, আমাকে তো তারা রাখবে না। আমার যেখানে যা (সম্পদ) আছে, তা ১০ মিনিটের মধ্যে নিয়ে যাবে। যারা আমার পেছনে লেগেছে, তারা এই কাজ করবে।’
দুবাইয়ে পলাতক পুলিশ পরিদর্শক খুনের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আরাভ খান এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দুবাইয়ে তার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ার নেপথ্যে রাঘববোয়ালদের নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, তখন এক ফেসবুক লাইভে তার এমন শঙ্কার কথা জানা গেল। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছে ইন্টারপোল। এ তথ্য জানিয়ে সোমবার পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, আরাভের সঙ্গে পুলিশের সাবেক কর্মকর্তার সম্পর্কের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে স্বর্ণ চোরাচালানে আরাভের সম্পৃক্ততা খুঁজতে এবং ফ্রান্স-রাশিয়ায় যাতায়াত নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন গোয়েন্দারা।
রোববার পৃথক দুটি ফেসবুক লাইভে আরাভ খান তার উত্থান নিয়ে নানা কথা বলেছেন। এতে তার বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার আলোচনা উঠে আসে। তবে সেখানে সুস্পষ্টভাবে না বলে অনেক কথাই এড়িয়ে গেছেন আরাভ। তাছাড়া দেশে ফিরলে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কার বিষয়গুলো উঠে আসে তার কথায়। হুন্ডি করে দেশ থেকে টাকা নিয়ে দুবাইয়ে কীভাবে স্বর্ণের ব্যবসা চলে, তা নিয়ে কথা বলেন। দুবাই থেকে বাংলাদেশিদের স্বর্ণ কেনার ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধ্যকতা প্রদানে তার দেওয়া প্রস্তাবের কথাও তুলে ধরেন সেখানে। পাশাপাশি প্রচলিত নিয়মের মধ্যে থেকে দুবাই-বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার মাঝে কীভাবে স্বর্ণ ব্যবসা করা যায়, তা নিয়েও কথা বলেন তিনি।
আরাভ খান বলেন, ‘আমাকে নিয়ে এটা কেন করতেছে, আমি জানি না। কারও কোনো সুবিধা আছে কি না, সেটাও জানি না। আমাকে মেরে না ফেললে অনেক কিছুই বলব। পুলিশ যদি আশ্বস্ত করে তারা আমাকে ডিবি অফিস বা থানায় না নিয়ে আদালতে নেবে, তাহলে সোজা আমি দেশে চলে যাব। আমাকে এখন ডাকুক, আমি এসে জেল খাটব। শুধু আমাকে একজন আইনজীবী ধরতে দেবে। আমি চাই, আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা আদালতে নিয়ে যাক। ডিবি, থানা বা সিআইডি অফিসে না নিক। সেখানে গেলে রিমান্ডে নেওয়ার আগের রাতেই আমার হাত-পা ভেঙে দেবে। দেখা গেল অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলে আমাকে মেরে দিল। আমার শত্রু অনেক বড় হয়েছে। এজন্যই আমার বিষয়টি ফ্ল্যাশ হয়েছে।’
দুবাইয়ে গড়া সম্পদের উৎস নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে শ্বশুরবাড়ির দেওয়া ৪০-৫০ লাখ টাকা নিয়ে দুবাই যাই। এরপর কী করা যায় খুঁজতে থাকি। পরে স্বর্ণের চিন্তা মাথায় আসে। বাংলাদেশে পাঠালে ৩০০ গ্রাম গোল্ড অ্যালাউ করে। সঙ্গে আনুষঙ্গিক যেসব জিনিস বাংলাদেশে চলে, সেগুলোও পাঠাতাম। যেমন বাচ্চাদের জন্য দুধ। সেক্ষেত্রে আমি দুই-তিনজন বন্ধুকে দিয়ে এগুলো পাঠানো শুরু করলাম। এভাবে প্রতিদিন একজনের মাধ্যমে আড়াই লাখ, তিন লাখ টাকা লাভ হতো।’ তিনি বলেন, ‘এরপর সুইজারল্যান্ড থেকে রাশিয়ান একজনের সন্ধান পেলাম। তার থেকে প্রথমে ১১৩ কেজি স্বর্ণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করি।’ দু-তিনদিন আগেও ১৩০০ কেজির একটি স্বর্ণের চালান বিক্রি করেছেন বলে জানান। ব্রোকার হিসাবে কাজ করে এসব স্বর্ণ থেকে ৩-৪ পার্সেন্ট লাভ করেন তিনি।
হুন্ডি করে দেশ থেকে টাকা নিয়ে দুবাইয়ে স্বর্ণ ব্যবসা চলে বলেও জানান আরাভ খান। তিনি বলেন, ‘দুবাইয়ে যারা স্বর্ণের ব্যবসা করেন, তারা লাখ লাখ, হাজার হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে নিয়ে আসতেছে। কারণ, বৈধভাবে ৫ হাজারের বেশি ডলার নেওয়া যায় না। এজন্য মানুষ হুন্ডি করে টাকা এনে ভারতের দোকান থেকে স্বর্ণ কেনে। তখন এই টাকাগুলো ভারতে চলে যায়।’ আরাভের দাবি, ‘বিষয়গুলো নিয়ে তিনি দুবাইয়ে কনস্যুলার জেনারেলের কাছেও যান। সেখানে তাকে এমন একটি প্রস্তাব দেন যে, বাংলাদেশের যারা দুবাই থেকে স্বর্ণ নেবে, তাদেরকে বাংলাদেশের দোকান থেকেই স্বর্ণ কিনতে হবে। যেই ৩০০ গ্রাম স্বর্ণ তারা নিয়ে আসবে, সেখানে বাংলাদেশি দোকানের একটি সিল থাকতে হবে। যদি বাংলাদেশের কোনো সিল না থাকে, তাহলে কাস্টমস সেটি গ্রহণ করবে না। তখন সবাই বাধ্য হবে বাংলাদেশের মানুষের থেকে গোল্ড কিনতে। তখন পুরো টাকা বাংলাদেশে যাবে।’ যদিও আরাভের এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
রেড নোটিশ জারি : আরাভ খানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সোমবার দুপুরে চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে পুলিশের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছিল। তার যে নামে আমরা চার্জশিট দিয়েছি, ওই নামে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়। আমি কিছুক্ষণ আগে জানতে পেরেছি, এরই মধ্যে ইন্টারপোল তা গ্রহণ করেছে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি, কীভাবে কাজ করছি, সেটা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাচ্ছি না তদন্তের স্বার্থে।’ তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে যদি কোনো আসামি পালিয়ে বিদেশে চলে যায়, যখন আমরা তার সম্পর্কে মোটামুটি কিছু তথ্য পাই, তখন আমরা একটা রেড নোটিশ জারি করি। এটা ইন্টারপোল হেড কোয়ার্টারে যায়। আমি যেটা খবর পেয়েছি যে, এটা তারা অ্যাকসেপ্ট (গ্রহণ) করেছে।
বাংলাদেশের ক্রীড়া ও বিনোদনজগতের আলোচিত কয়েক তারকার দুবাই যাওয়া প্রসঙ্গে পুলিশপ্রধান বলেন, অনেক সময় দেখা যায় বিজ্ঞাপনের জন্য তারা যান। দাওয়াতে গেলেই যে অপরাধে জড়িত থাকবেন, সেটা বলা যায়? বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। তারা এলে তাদের সঙ্গেও আমরা কথা বলব। আরাভ খানের সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন সাবেক এক কর্মকর্তার সম্পর্কের গুঞ্জন নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আমরা খতিয়ে দেখছি।’
jugantor