বিএনপির কূটনৈতিক তৎপরতা>> ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন মোড়, আস্থাহীনতা দূর করার উদ্যোগ

0

নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে অলআউট মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। সাংগঠনিক প্রস্তুতির পাশাপাশি প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন আদায়ে জোরেশোরে কূটনৈতিক তৎপরতাও চালাচ্ছে দলটি। এর অংশ হিসাবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে অর্থবহ সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অতীতের তিক্ততা ভুলে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখা দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। পাশাপাশি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশটির ভূমিকাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে দলটির হাইকমান্ড।

তবে দলটির নীতিনির্ধারক মহল মনে করে, খুব কম সময়ের ব্যবধানে ভারত ও বিএনপির মধ্যে সম্পর্কের নতুন সোপান রচিত হবে। যার ভিত্তিতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম হবে। কেননা দেশটি এখন বিলম্বে হলেও অনুধাবন করতে পারছে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শক্তিশালী স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রয়োজন। বেশিরভাগ মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী এই উদ্যোগে ভারতের সমর্থন থাকলে দুদেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব ও কৃতজ্ঞতার বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে।

সম্প্রতি ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মার আমন্ত্রণে তার বাসায় নৈশভোজে অংশ নেয় বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল। এ দলে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ। এ সময় তাদের মধ্যে আগামী নির্বাচন, আন্দোলনসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হয়। গুরুত্ব পায় ভারত ও বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিও। নৈশভোজের আড়ালে এ বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও সৃষ্টি হয় নানা কৌতূহল। বিএনপির ভেতরেও এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। তবে বৈঠকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে উপস্থিত নেতাদের কেউ প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন। সৌজন্য সাক্ষাৎ বলে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

এদিকে বিএনপির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নৈশভোজে মূলত আগামী নির্বাচন ও আন্দোলন সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান জানতে চান ভারতীয় হাইকমিশনার। নির্বাচনে বিএনপি যাবে কিনা জানতে চাইলে দলটির নেতারা সাফ জানিয়ে দেন-‘দলীয় সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবেন না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন সবাই দেখেছে। ২০১৪ সালে বিনাভোটেই অর্ধেক সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে জোরালোভাবে এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর সব প্রতিশ্রুতি তারা বেমালুম ভুলে যান। মিথ্যা মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতারে ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযান পরিচালিত হয়। এলাকাছাড়া করা হয় অনেককে। ভোটের মাঠে বিএনপি প্রার্থীদের প্রচারে হামলা ও বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এতকিছুর পরও আমরা ভোটের মাঠে ছিলাম। কিন্তু নির্বাচনের আগের রাতে তারা কেন্দ্র দখলে নিয়ে ভোট ডাকাতি করে। এরপর কী করে আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু ভোট আশা করা যায়?’

তাহলে বিএনপি কী ধরনের আন্দোলন করবে এবং তা কতদিন চালিয়ে যাবে-প্রণয় ভার্মার এমন প্রশ্নের উত্তরে দলটির উপস্থিত নেতারা বলেন, যতদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা না হবে, ততদিন আন্দোলন চলবে। বিএনপি যেভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে এটিই অব্যাহত থাকবে। তারা বিশ্বাস করে, এক সময় এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেই তাদের দাবি আদায় হবে।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলো কেন সে সম্পর্কেও জানতে চান দেশটির হাইকমিশনার। উত্তরে বিএনপি নেতারা বলেন, ‘আপনারা বলছেন ১০ ট্রাক অস্ত্রের পেছনে বিএনপির হাত ছিল। এটা নিয়ে ভারত সন্দেহ করে। কিন্তু ওই ঘটনায় যদি আমাদের হাত থাকত তাহলে বিএনপি কেন পুলিশ দিয়ে সেই ট্রাক জব্দ করবে? এছাড়া অনুপ চেটিয়াকে দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলানো হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন আবার বলানো হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি মনে করে, এসব কিছুই বিএনপির বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার। বরং বিএনপি নেতারা বৈঠকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক ইতিবাচক ধারায় থাকলে আমাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা সুসংহতসহ এ অঞ্চলে কোনো অপশক্তিই কিছু করতে পারবে না।

এ সময় ভারতীয় হাইকমিশনারকে উদ্দেশ করে এক নেতা বলেন, ‘আপনারা তো নির্বাচনের আগে একজন করে সচিব পাঠিয়ে একটা দলের পক্ষে অবস্থান নেন। যা দেশের জনগণ কখনো ভালোভাবে নেয়নি। নেবেও না। তবে আমরা সুসম্পর্ক জোরদার করতে চাই। কিন্তু এভাবে হলে তা কী করে সম্ভব।’ বৈঠকে ভারতীয় হাইকমিশনার বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নেন। কিন্তু কোনো বিষয় নিয়ে তিনি নিজের কোনো মন্তব্য করেননি।

জানতে চাইলে বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য ড. আসাদুজ্জামান রিপন যুগান্তরকে বলেন, ‘এটা নতুন নয়, এর আগেও এমন বৈঠক হয়েছে। তবে আমার ধারণা ভারতের নতুন হাইকমিশনার ঢাকায় যোগ দিয়েছেন। তাই আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজপথের শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে বিএনপি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত ধারণা নিতে চাচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে জানিয়েছেন এ দেশের সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন আছে। ভারতের এমন অবস্থানের পর জনগণের অনেকের মধ্যে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা হতে পারে, বাংলাদেশে রাতের ভোট দিনে করে কিংবা যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকাকেও ভারত সরকার সমর্থন করে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, ভারতের সরকার তো দেশটির জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী গঠিত হয়। ফলে আমাদের দেশে জনগণের ইচ্ছা এবং অভিপ্রায়ে ভবিষ্যতের সরকার গঠিত হবে, এমন নীতিতেও ভারতের সমর্থন থাকা উচিত। বাংলাদেশের জনগণের এ আকাক্সক্ষার প্রতি দেশটির সমর্থন আছে বলে বিএনপি বিশ্বাস করে। তাই দলটির প্রতিনিধিরা এমন বার্তাই ভারতীয় হাইকমিশনারের মাধ্যমে দেশটির সরকারকে দিয়েছে বলে আমি মনে করি।’

তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস এবং সমর্থনের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন থাকার কথা। দেশের জনগণ ও বিএনপিও এমনটি বিশ্বাস করে। এটাই ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায্য প্রত্যাশা। তাই এ নীতিতে থাকলেই দুপক্ষের মধ্যে সুসম্পর্কের মাত্রা আরও বাড়বে।

বিএনপি ও কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, প্রণয় ভার্মার নৈশভোজকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বিএনপির হাইকমান্ড। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশটি বিএনপির সঙ্গে নতুন করে করে সম্পর্ক তৈরি করতে চায় কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে তারা এখন পর্যন্ত ভারতের এ ভূমিকাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে চান। এজন্য সামনে এ ধরনের বৈঠক আরও হতে পারে। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এ ব্যাপারে ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে বিএনপির একটি অংশ বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখছে না। তারা মনে করেন, এটা বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে সরকারের নতুন কোনো ফাঁদ হতে পারে। তাই ভেবেচিন্তে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনোভাবে আমরা দেশি-বিদেশি কারও ফাঁদে পা দেব না। অতীতেও অনেকে ভালো কথা বলে ভুল পথে নেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। তাই বিএনপি এবার সব বিষয়ে সতর্ক।

বিএনপি নেতারা জানান, ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হচ্ছে ভারত। নির্বাচনসহ রাজনৈতিক অনেক বিষয়ে দেশটিকে এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। সেজন্য বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেটা বিবেচনা করেই প্রতিটি নির্বাচনের আগে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিয়ে আসছে বিএনপি। কিন্তু কোনো কারণে শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় রূপ দেওয়ার পক্ষে বিএনপির হাইকমান্ড।

দলটির একাধিক নেতা জানান, ভারতকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করা কঠিন। জয়লাভ করা গেলেও পরে সরকার পরিচালনা করা আরও কঠিন হবে। তাই সরাসরি দেশটির সঙ্গে বিরোধে না জড়িয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করাই হবে উত্তম সিদ্ধান্ত। কূটনৈতিক সম্পর্কে বন্ধুত্ব ও বিরোধিতা সব সময় এক নিয়মে চলে না। ফলে সময় ও সার্বিক প্রেক্ষাপট বিচেনায় নিয়েই এগোতে হয়। বিএনপি এবার সে পথে হাঁটছে।

তবে তারা এও মনে করেন, ভারতের সঙ্গে ন্যূনতম ভালো সম্পর্ক থাকতেই হবে। বিএনপির প্রতি তারা পূর্ণ সমর্থন না জানালেও যেন দেশটি সরাসরি বিরোধিতা না করে। কোনো একটি দলের পক্ষে যেন ভারতের পূর্ণ সমর্থন না থাকে সেই পরিস্থিতি কূটনৈতিকভাবে বিএনপিকেই সামাল দিতে হবে।

jugantor

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More