বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের তত্ত্বাবধানে এক ধরনের নব্য প্রস্তরযুগীয় সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো এই নব্য সিন্ডিকেটের নেতা। এই সিন্ডিকেটের কাজ হলো- “ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার নির্ধারিত করা।” সদস্যরা হলো- এবিবি (এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ব্যাংকস-ব্যাংকের পরিচালকদের সংগঠন)। এই সংগঠনের দীর্ঘদিনের সভাপতিকে বলা যেতে পারে একজন তোষামোদকারী ও চাটুকার। তবে মানসম্পন্ন বলা যাবে না। তিনি নিজেই ব্যাংক লুটেরা গোষ্ঠীর একজন নামিদামি সদস্য। ২০২৩ সালে ব্যাংকগুলোর সিএসআর খাতের ব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী এবিবি-এর সদস্য ব্যাংকগুলো ৫৩১ কোটি টাকা দান করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন ত্রাণ তহবিলে। অথচ এই ব্যাংকগুলোর অনেকগুলো লোকসানে। অন্য সদস্যরা হলো- ব্যাংকার এসোসিয়েশন (ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার এসোসিয়েশন (বিএফইডিএ), যে সব কোম্পানি বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা করে তাদের সংগঠন। মোট কথা হলো- বিনিময় হার নির্ধারণ করার দায়িত্ব, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই এই সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়েছেন।
তবে এই গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে আছে দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান- বাংলাদেশ ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের বর্তমান হাল-হকিকত ও চেহারা নিম্নরূপ:
(ক) বাংলাদেশ কর্তৃক নির্ধারিত প্রতি ডলারে বিক্রি মূল্য ১১১.৫০ টাকা। মাঝে মাঝে আবার টাকাকে শক্তিশালী দেখানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে এই সিন্ডিকেট ডলার প্রতি ৫০ বা ২৫ পয়সা কমানো হয়। অর্থাৎ পক্ষান্তরে টাকার মূল্যমান বাড়িয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।
(খ) এই সিন্ডিকেট কর্তৃক নির্ধারিত ডলারের ক্রয়মূল্য হলো- ১১০.৫০ টাকা। বিক্রয় মূল্য ১০৯.৫০ টাকা।
(গ) প্রবাসী আয়ের উপর- প্রথমে ২.৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। তাতে কাজ না হওয়াতে বর্তমানে ৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে- অর্থাৎ ডলার প্রতি ১১৪-১১৬ টাকা। তবে বিদেশি রেমিট্যান্স কোম্পানি দিচ্ছে ডলারে ১২০-১২২ টাকা।
(ঘ) আমদানি ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকগুলো এক এক আমদানিকারককে এক এক মূল্য পরিশোধে বাধ্য করছে। আপাতত ব্যাংকগুলো ডলার প্রতি ১২০ থেকে ১২৩ টাকা নিচ্ছে। অনেক সময় কাগজে-কলমে ১১০.৫০ টাকা। কিন্তু প্রকৃত হলো ১০ থেকে ১৩ টাকা বেশি। যেমন খুচরা দোকান থেকে পিয়াজ কিনলেন প্রতি কেজি ২০০ টাকা করে। কিন্তু দোকানদার রসিদ দেবে কেজি প্রতি ১২০ টাকা। না হলে তাকে জরিমানা গুনতে হবে।
(ঙ) খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট নামে পরিচিত) প্রায়ই শোনা যায় ডলার প্রতি বিনিময় হার ১২৬ থেকে ১২৮ টাকা।
এই হলো ডলার বিনিময় হারের সর্বশেষ চিত্র। মুদ্রার বিনিময় হারে এরকম অরাজকতা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে কোনোকালে, কোনোদিন ছিল কিনা আমার জানা নেই। আলু বা পিয়াজের মূল্য সাধারণ মানুষের জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে কথাটা সত্য। তবে এর থেকে খাঁটি সত্য হলো; এই ধরনের সিন্ডিকেট পুরো দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে এবং সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার সহায়ক। এ ধরনের পরিকল্পিত খেয়ালিপনা বা হেঁয়ালিপনা আর যাই হোক অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এধরনের হেঁয়ালিপনার ফলে অদূর ভবিষ্যতে পণ্যের মূল্য আরও বাড়বে বৈকি। সেই সঙ্গে জনগণের দুর্ভোগও বাড়বে।
তবে ব্যবসায়ী নামক লুটেরা গোষ্ঠীর সদস্যরা আসলে ডলার প্রতি কতো টাকা হারে বিনিময় বা আদান-প্রদান করছে, সেটা ভবিষ্যতে জানা যাবে। এ বিষয়টি ভবিষ্যতে অবশ্যই যাচাই বাছাই করা প্রয়োজন হবে। কেননা, এই লুটেরা সিন্ডিকেটের বেশির ভাগ সদস্যরা একদিকে ব্যাংকের মালিক, অন্যদিকে বড় আমদানিকারক। ডলারের দাম কাগজে-কলমে এক, বাস্তবে আরেক (প্রথম আলো- ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩) নামে সংবাদ শিরোনামে লিখেছেন “প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে কিছুটা কম দামে ডলার কিনতে পারলেও সাধারণ ব্যবসায়ীদের আমদানি দায় পরিশোধ ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে। একইভাবে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে বড় ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের কাছ থেকে সুবিধা পেলেও সাধারণ ব্যবসায়ীদের অনেককেই ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমদানিকারকরা যখন ঘোষিত দামের চেয়ে ১২-১৩ টাকা বেশিতে ডলার কিনছেন তখন ব্যাংকারদের দুই সংগঠন মিলে একাধিকবার ডলারের দাম কমিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে এখন ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হলেও তারা এই কাজটি করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে। এক্ষেত্রে বাজার পরিস্থিতি উপেক্ষিত থেকে যায়। ফলে এক মাসে তিন দফায় ডলারের দাম ১ টাকা কমানো হয়েছে। নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেছেন, “এখন যে যত শক্তিশালী, তার কাছে ডলারের দাম তত কম। যারা দুর্বল তাদের কাছে তত বেশি। এটাই এখন নীতি হয়ে গেছে।”
আমি আশা করি- মো. হাতেম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ব্যবসায়ী নামধারক লুটেরা গোষ্ঠীর সম্মেলনে যোগ দেন নি। যদি যোগ দিয়ে থাকেন, তাহলে তার এই অভিযোগ-অনুযোগ করার কথা নয়। তিনিও নিশ্চয়ই সেদিন অন্যদের সঙ্গে স্লোগান ধরেছিলেন, “শেখ হাসিনার সরকার- বার বার দরকার।” যাই হোক আমি আশা করি প্রথম আলোর এই সংবাদ থেকে আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বর্তমান স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে দেশে কোন পর্যায়ে সিন্ডিকেট বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং তাদের দৌরাত্ম্য কোথায় বা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাহলে এর দোষ কী একমাত্র খুচরা দোকান মালিকদের?
ব্যবসায়ী গোষ্ঠী না লুটেরাদের সিন্ডিকেট: প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আজকাল এই লুটেরা গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। ২০২৩ সালের জুলাই মাসের ১৫ তারিখে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ব্যবসায়ী সম্মেলন হয়তোবা আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আবশ্যিকভাবে বলতে হয় যে, গত ৩০ বছরে, যখন থেকে আমি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সঙ্গে জড়িত হয়েছি, কখনো এ দৃশ্য দেখিনি। দেশজুড়ে তথাকথিত খ্যাতিমান অনেক ব্যবসায়ী সেদিন ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তাদের স্লোগান ছিল “যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, তাদেরকে রুখে দাঁড়াতে আমরা ব্যবসায়ীরাই যথেষ্ট”। তাছাড়া এমন স্লোগানও তাদের মুখ থেকে শোনা গেছে যে, “শেখ হাসিনার সরকার- বার বার দরকার”। রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলে এগুলো শোনা যায়। ব্যবসায়ী সমাজের জন্য এটা ছিল এক লজ্জাকর পরিস্থিতি ও কলঙ্কজনক অধ্যায়।
আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি এসব নেতারা যত না বড় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা- তারচেয়ে অনেক বেশি বড় হলো সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা ভূমিদস্যু, ব্যাংক লুটেরা বাহিনী ও উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন লুটেরা গোষ্ঠীর সদস্য।” অনেকে আমাকেও একই শ্রেণিতে অন্তর্ভূক্ত করতে পারেন। যদি তারা আমার জীবনের কর্ম-প্রক্রিয়া যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন তাহলে আমার আপত্তি নেই। তবে যে যাই বলুক অতীতের ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে বর্তমান অবস্থার জন্য আমি নিজেকে এমনিতেই দোষী মনে করি। বর্তমান নেতাদের অনেকেই ভুঁইফোঁড় বা নামমাত্র সংগঠনের নামসর্বস্ব নেতা। তারা যথাযথভাবে নির্বাচিত হওয়ার পরিবর্তে সরকার কর্তৃক মনোনীত। তারা সদা-সর্বদা ক্ষমতাসীনদের মুখাপেক্ষী ও অনুগ্রহপ্রার্থী। কেউ রাজউকের প্লটের আশায় বসে আছেন। কেউ অন্যের জায়গা-জমি দখল করে আছেন। দখল পাকাপোক্ত করা হলো মূল উদ্দেশ্য। কেউবা ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী, আবার কেউ কেউ ভবিষ্যতে নিজ এলাকায় স্থানীয় সরকার বা সংসদ সদস্যের মনোনয়ন পেতে চান। ব্যবসায়ী সংগঠনের নামসর্বস্ব এই নেতারাও আজকাল প্রকৃত ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের অভিযুক্ত করছেন একই দোষে। অর্থাৎ “ছাগল যেন ফসলের ক্ষেত নষ্ট করতে না পারে সেজন্য দেয়া হয়েছে মুলিবাঁশের বেড়া। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এখন সেই বেড়াই ক্ষেতের ফসল নষ্ট করতে বা খেয়ে ফেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে”। অনেকটাই প্রবাদ বাক্যের মতো; “উল্টন করিলি বিধি উল্টন করিলি, ঘোড়াতে চড়াতে মেবে ঘোড়াকে চড়ালি।” বর্তমানে বাংলাদেশে সবকিছুই উল্টোদিকে চলছে। এটাই সত্য। সেজন্যই দেশের স্বাধীনতা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাঁচাতে হলে, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ এখন অতি আবশ্যকীয় হয় উঠেছে।
শ্যাম রাখি না কুল রাখি-ত্রিশঙ্কুল অবস্থা: বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থাও এখন ব্যবসায়ী সংগঠন বা বিচার ব্যবস্থার মতো ত্রিশংকুল- “শ্যাম রাখি না কুল রাখি।” নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে অনির্বাচিত দলীয় সরকারের চাটুকারিতা করবে, না আইএমএফ-কে বোঝাবে, না মুদ্রাস্ফীতি সামলাবে। গত কয়েক বছর ধরে মাত্রাতিরিক্ত কাগজের মুদ্রা ছাপিয়ে সরকারকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ দেয়া, ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে মুদ্রার বিনিময় হারকে কৌশলে বাজার মূল্য থেকে কমিয়ে রাখা, বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা দখল, অনেক বড় অঙ্কের ঋণের নামে ব্যাংক লুট করা, এসবই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্বিক সহযোগিতায় সম্ভব হয়েছে। মাত্র কয়েকদিন পূর্বে হঠাৎ দেখলাম দেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক-এর পরিষদ ভেঙে দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোচরেই সব অনিয়ম হয়েছে। বলতে গেলে চোখের সামনে দিয়ে লুটপাট হয়েছে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব জেনে-শুনে-বুঝেও দায়িত্ব পালন করেনি। কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ যারা লুটপাট করেছে তারা ছিল সরকারদলীয় সমর্থক।
মূল্যস্ফীতি দিন দিন বাড়ছে: ডলারের অভাবে দিন দিন আমদানি কমছে। অথচ মাঝে মাঝে এই সিন্ডিকেট টাকার মূল্য ০.২৫ টাকা করে বাড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের আর কতো হাসির পাত্র বানাবে? এ মুহূর্তে বিনিময় হার কম রাখা বা টাকার মূল্য বাড়ানোর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো প্রহসনের নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমদানিকৃত পণ্যের দাম কমিয়ে মূল্যস্ফীতিকে দমিয়ে রাখা। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি কমানো নয়, জোর করে দমানো। অনেকটাই গায়েবি মামলা ও ফরমায়েশি সাজার মতো। এইভাবে দমিয়ে রাখার অর্থ হলো; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে মূল্যস্ফীতি কমানোর যে মূল হাতিয়ার, সেই হাতিয়ারকে ঠিক উল্টোদিকে ব্যবহার করা। এর ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো আরও বাধাগ্রস্ত হবে। একটির সঙ্গে আরেকটি সাংঘর্ষিক হয়ে উঠবে। অর্থনীতি না পড়লেও এটা বোঝা সহজ, যে বাজার ব্যবস্থাপনায় এই সব অসৎ উদ্দেশ্যমূলক ও অযাচিত কর্মকাণ্ড বা হস্তক্ষেপ, কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহের জন্য সামান্য চটক দেখাতে পারলেও, এসবই অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলোকে বা সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। এগুলো দলীয় স্বার্থে দায়িত্বহীনতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এধরনের ধান্দাবাজির একমাত্র কারণ হলো; অদূর ভবিষ্যতে অবৈধ সরকারের স্বৈরাচারী হাতকে বা দেশে স্বৈরতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করা। সঙ্গে সঙ্গে জনগণের বহুমাত্রিক দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত করা। উদাহরণ হিসেবে গত কয়েক বছর দেশীয় মুদ্রার মান কৃত্রিমভাবে নির্ধারণ করে, অতি মূল্যায়িত রাখার ফলে;
ক) রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। কেননা, বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে গেছে;
খ) কার্ব মার্কেটে দাম বেশি হওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই সরকারিভাবে আসা প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কমে গেছে। হুন্ডির মাধ্যমে আসা বেড়ে গেছে। মোট কথা প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে;
গ) মুদ্রা পাচার বেড়ে গেছে;
ঘ) রপ্তানির প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়াতে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে;
ঙ) রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে শ্লথ বা প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়াতে বিদেশের সঙ্গে দায়স্থিতির চলতি হিসেবে ঘাটতি বেড়ে গেছে;
চ) অর্থাৎ দেশি মুদ্রার অতিমূল্যায়ন বা ডলারের মূল্য অবমূল্যায়ন করে রাখাতে আমদানি বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বাজারে ডলার সংকট বেড়ে গেছে এবং অর্থনীতিতে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করেছে;
ছ) ডলার সংকটের কারণে এখন টাকার দ্রুত অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ফলে গত কয়েক মাসে আমদানি কমে গেছে। এতে ভবিষ্যতে দেশীয় উৎপাদন কমে যাবে;
জ) বিভিন্ন গবেষণার ভিত্তিতে বলা যায় যে, আউশ ও আমনে কম বৃষ্টি অথবা যথাসময়ে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এই দুই ঋতুতে ধানের ফলন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমেছে। ফলে চাল আমদানি বাড়াতে হবে। চাল রপ্তানির উপর ভারতের শুল্ক আরোপ ও বিদেশে চালের দাম বেড়ে যাওয়াতে এবং একই সঙ্গে ডলার সংকটের কারণে চাল আমদানি দুরূহ হয়ে পড়বে।
উল্লেখ্য অর্থবছর ২০২০ সালে গমের আমদানি ছিল ৬৪ লাখ টন। অথচ ২০২৩ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে মাত্র ৩৯ লাখ টন। যার ফলে আটা-ময়দার সরবরাহ কমে গেছে ও মূল্য বেড়ে গেছে। অতএব ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাস থেকে দেশে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বোরো ধান কাটা হবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে। প্রধানমন্ত্রী হয়তোবা কয়েকদিন পূর্বে এ বার্তাই জনগণকে দিতে চেয়েছেন। তবে চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী দোষ দিয়েছেন বিরোধী দলের। অথচ দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই বলে তিনি নিজেই দুঃখ প্রকাশ করেন।
ঝ) অন্যদিকে ইদানীংকালে ডিম, আলু, লবণও আমদানি করতে হচ্ছে। নিকট অতীতে কখনো এসব পণ্যের আমদানি করতে শুনিনি বা দেখিনি। এসব আমদানি একমাত্র নির্বাচনকে সামনে রেখে। ফলে ডলার সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
ঞ) রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বাজার ব্যবস্থাপনায় অযাচিত হস্তক্ষেপ, টাকার বিনিময় হারে দ্বিচারিতা, সমাজে নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় ইত্যাদি একত্রে মিলেমিশে বিদেশি বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। তাতে বিদেশের সঙ্গে দায়-স্থিতিতে মূলধন হিসেবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
ট) অন্যদিকে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না হওয়া, বিদেশি ঋণের ছাড় কমে যাওয়া এবং সরকারি ও বেসরকারি বিদেশি ঋণ ও সুদ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়ায় দায়স্থিতির আর্থিক হিসেবেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
সব মিলে বাজারে ডলার সংকট বেড়ে গেছে। বিদেশের সঙ্গে দায়স্থিতিতে (Balance of Payment), এই তিন হিসেবের একত্রে ও সমানতালে ঘাটতি বাংলাদেশে নিকট অতীতে কখনো দেখা যায়নি।
অন্যদিকে বিদেশ থেকে বেসরকারি খাত কর্তৃক আমদানিকৃত পণ্যের অনেক ঋণপত্রের বিপরীতে বিদেশি ব্যাংককে এখনো অনেক বাকি রয়ে গেছে। তার সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন খাতে যেমন জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও সার আমদানি, এবং বিদেশিদের বাকি পাওনা যেমন; পরিশোধিত-অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, গ্যাস (এলএনজি), কয়লা ও বিদ্যুৎ আমদানির বিপরীতে এবং এয়ারলাইন্সের টিকিটের টাকা, শিপিং লাইনের পরিবহন ভাড়া, শেভরন থেকে নেয়া গ্যাসের বাকি মূল্য, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের পাওনা, পুনঃবীমাকরণ, বিনিয়োগের উপর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ইত্যাদি সব মিলে আনুমানিক ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার অনেকদিন থেকে বাকি। এসব বাকি পরিশোধ করতে হবে অতিসত্বর। ডিসেম্বর ২৮ তারিখে বণিক বার্তার সংবাদ অনুযায়ী “উড়োজাহাজের জ্বালানি সংকটে দেশ, মজুত ফুরাচ্ছে কাল।” কারণ হলো; অন্তত ৬টি জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের নিকট প্রায় ২৯২ মিলিয়ন বা ২৯২০ লাখ ডলার বহুদিন থেকে পাওনা। তাই তারা পুরনো পাওনা না পেলে নতুন করে জ্বালানি তেল বিক্রিতে আগ্রহী নয়। অর্থনীতির অবস্থা কি ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব থেকে না বোঝার কোনো কারণ নেই। এককথায় অতি দরিদ্র মানুষের মতো। দিন এনে দিন খাওয়ার অবস্থা।
এতদসত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো বিনিময় হারে ধান্দাবাজি ছাড়তে নারাজ। কেননা, অতি সন্নিকটে দেশে আরেক ধান্দাবাজির নির্বাচনের নামে প্রহসন হতে যাচ্ছে। দলীয় পদাবলী (ক্যাডার) হিসেবে বর্তমান গভর্নর যদি দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে দলীয় স্বার্থকে দেশের স্বার্থের উপর স্থান দেন, তাতে অবিশ্বাসের কিছু আছে বলে মনে হয় না। আইএমএফ চুক্তির শর্ত যাই হোক সেগুলো আপাতত বিবেচনায় নিবে না। অনেক গুরুতর সমস্যা যেমন, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে লোপাট, খেলাপি ঋণ, বিনিময় হার, ইত্যাদি সব কিছুই চেপে রাখা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে এসব সমস্যা সমাধানে আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রশ্ন হলো; অপেক্ষা কেন? অবশ্যই দলীয় স্বার্থ। যতদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে বিবেচনা করবে না, ততদিন দেশের অর্থনীতির অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকবে। এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
সব দেখে মনে হয় ইচ্ছাকৃতভাবে একটি অদক্ষ দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়ার পাঁয়তারায় মেতে উঠেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এর দায় নিতে বাধ্য এবং ভবিষ্যতে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে।
পরিসংখ্যান নিয়ে ভেল্কিবাজি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ ডিসেম্বর, ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২০-২২ বিলিয়ন ডলারে। মেগা প্রকল্প, গরিবের জন্য অতিমাত্রায় দরদ ও বিভিন্ন সুরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গান গাইতে গাইতে অর্থনীতিতে যে আরও বিষয় আছে, যেমন মূল্যস্ফীতি, আমদানি, রপ্তানি, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যতা হ্রাস, রাজস্ব ঘাটতি, বাজেট ঘাটতি, অতিমাত্রায় দেশি-বিদেশি ঋণ, বিদেশের সঙ্গে দায়স্থিতির চলতি, মূলধন ও আর্থিক হিসেবে ঘাটতি, এসবের কথা ভুলেই গেছেন। প্রতিটি বিষয়ে জনগণকে মিথ্যা পরিসংখ্যান দেয়া এখন আমাদের জাতিগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে ধরা খেয়েছে রিজার্ভ এর বেলায়। তাও আইএমএফের কাছে। এই সিন্ডিকেট সদস্যরা রিজার্ভ বেশি দেখানোর জন্য, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চিরাচরিত নিয়ম লুকিয়ে নিজেরাই মনগড়া হিসাব চালু করে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাই বলুক বা যে নাম্বার দেখাক, দেশের লোক আইএমএফ-কে বিশ্বাস করে, নিজ দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নয়। এর থেকে আর দুঃখজনক কী হতে পারে? এটা সত্যিকার অর্থেই জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ও লজ্জাজনক।
আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে যেই পরিমাণ ডলার প্রয়োজন সেটা মেটানোর জন্য প্রতিমাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে আনুমানিক এক বিলিয়ন ডলার করে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন; গম, ভুট্টা, চিনি, ভোজ্য তেল, মসলাজাতীয় খাদ্য, সার, জ্বালানি তেল, (পরিশোধিত ও অপরিশোধিত) ইত্যাদি যথাসময় আমদানি করা বাঞ্ছনীয়। অন্যদিকে বর্তমান অর্থ বছরে সরকারি-বেসরকারি মিলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদে-আসলে ৭ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো; এর শেষ কোথায়? কবে পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে বিক্রি বন্ধ হবে। কতোদিন পর্যন্ত আর কতো ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করতে পারবে? কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ন্যূনতম ৩ থেকে ৪ মাসের আমদানি মূল্যের সমান রিজার্ভ থাকতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানির মোট মূল্য ছিল ৮৯.১৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি কমে দাঁড়িয়েছে ৭৫.০৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ কমেছে ১৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কমেছে গত বছরের তুলনায় ২৪ শতাংশ। ভাগ্য ভালো গত অর্থবছরে চাল আমদানি কম করতে হয়েছে। এবার মনে হচ্ছে তার উল্টো। অতএব এবার আমদানি খুব বেশি কমানো যাবে না। ইতিমধ্যে গম আমদানি অনেক কমে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে যদি চাল আমদানি করা না হয় তাহলে প্রধনমন্ত্রীর আগাম বার্তা হয়তো সত্য বলে প্রমাণিত হবে।
রপ্তানির পরিসংখ্যান দেখতে গেলে তিন রকমের রপ্তানি মূল্য পাওয়া যায়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কাস্টমস। এক এক প্রতিষ্ঠান এক এক সংখ্যা দেখায়। কাস্টমস বা এনবিআর এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত কয়েক বছর ধরেই যে মূল্য দেখানো হয় তার ৫ থেকে ৭ শতাংশ দেশে আসে না। আসবে কিনা তাও সন্দেহজনক। একই অবস্থা খাদ্যপণ্য উৎপাদনের বেলায়। সেটা লবণ, আলু, পিয়াজ, ধান, গম, ভুট্টা যে পণ্যকে ধর্তব্যে আনুন। একই অবস্থা। কাগজে-কলমে স্বয়ংসম্পূর্ণ, এমনকি অতিরিক্ত উৎপাদন, কিন্তু প্রতিনিয়ত আমদানি করতে হয়। অনেক পণ্য যেমন পিয়াজ; দেশের যে পরিমাণ চাহিদা বলা হয়, উৎপাদন দেখানো হয় অতিরিক্ত ৫ থেকে ৭ লাখ টন বেশি। অথচ বছর শেষে দেখা যায় আমদানি করা হয়েছে ৮ থেকে ৯ লাখ টন। এককথায় বলা যায় দেশের পণ্যের বাজারে যথাযথ সরবরাহ সমস্যার জন্য দায়ী হলো দলীয় পদাবলীরা ও তাদের সাজানো মিথ্যা পরিসংখ্যান।
চলবে
লেখক: সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
mzamin