প্রথমে শুনে একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন ক্রিকেটারদের অনেকে। সাত ঘণ্টা ধরে একজন মানুষের বকবকানি শুনতে হবে! এর চেয়ে বিরক্তিকর আর কী হতে পারে?
বিস্ময়কর হলেও সত্যি, মিরপুরের একাডেমি ভবনের কনফারেন্স রুমে কাল সেই সাত ঘণ্টা পার হয়ে গেল চোখের পলকে। একই সঙ্গে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেল খেলোয়াড়দের মন। কথা শোনার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহটা এখন এই পর্যায়ে যে, আজ ও কাল শেষ দুই দিনে সেশনের সময় বাড়াতে হয়েছে দুই ঘণ্টা করে।
নিজেকে ‘লাইফ সাকসেস কোচ’ হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন কানাডা-প্রবাসী বাংলাদেশি আজহার আলী খান। বিকেএসপির সাবেক ছাত্র একসময় ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় টেনিস দলের কোচ। এ ছাড়া ইংল্যান্ডের বেডফোর্ডশায়ার টেনিস ক্লাবেও ছিলেন কোচের দায়িত্বে। বর্তমানে কর্মরত কানাডার টরন্টো ক্রিকেট, স্কেটিং ও কার্লিং ক্লাবে।
শ্রীলঙ্কা সিরিজ, এশিয়া কাপ আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টানা ব্যর্থ বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের মানসিক শক্তি বাড়াতেই আজহার আলীর শরণ নিল বিসিবি। মুশফিকুর রহিম আর তামিম ইকবাল নিয়েছিলেন মূল উদ্যোগ। বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান আকরাম খানও পরে একাধিকবার কথা বলেন আজহার আলীর সঙ্গে। আকরামেরও মনে হয়েছে, ক্রিকেটারদের মানসিকভাবে জাগিয়ে তুলতে তাঁর সঙ্গে বসাই যায়। পোশাকি নাম ‘লাইফ সাকসেস কোচ’ হলেও আজহার আলীর কাজ তো আসলে মনোবিদেরই!
সেই ধারাবাহিকতায় কাল সকাল ১০টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আজহার আলীর কথা শুনলেন ৩২ ক্রিকেটার। তাঁরা শ্রোতা হবেন আজ দুপুর পর্যন্তও। আজকের দিনের বাকি সময় এবং আগামীকালও আলাদা আলাদাভাবে কথা বলতে ইচ্ছুক এমন ১১ জন খেলোয়াড়ের সঙ্গে বসবেন আজহার আলী। আগামী পরশু তিনি সময় কাটাবেন মহিলা ক্রিকেট দলের সঙ্গে।
ক্রিকেটারদের মূলত মানসিক শক্তি বাড়ানোর বিভিন্ন কৌশলই শেখাচ্ছেন আজহার আলী। বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র যেটিকে মনে করছেন খারাপ সময় কাটিয়ে ওঠার দারুণ এক টনিক, ‘সবাই বলে, আত্মবিশ্বাস ফেরাতে হবে। কিন্তু আত্মবিশ্বাস কীভাবে ফেরাতে হবে, তা কেউ বলে না। এখানে মানসিক শক্তি বাড়াতে কিছু স্কিল ট্রেনিং শেখানো হচ্ছে আমাদের। এগুলো সব সময় মাথায় থাকবে, অবচেতন মনেও কাজ করবে।’
সতীর্থদের সঙ্গে আজহার আলীর ক্লাসে বসার আগেই তাঁর সঙ্গে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে আলাদা কথা বলেছেন নাসির হোসেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘আমি এর অনেক ইতিবাচক দিক খুঁজে পেয়েছি। আমাদের অনেক রকম চাপ সামলাতে হয়। কীভাবে এসব চাপ থেকে বের হয়ে আসা যায়, তা-ই শেখানো হচ্ছে এখানে।’
অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম এবং তামিম ইকবালও একক সেশন করে নিয়েছেন আগেই। ব্যক্তিগত কাজে ইংল্যান্ডে গেছেন তামিম। যাওয়ার আগে তিন দিনে প্রায় ২৫ ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন আজহার আলীর সঙ্গে। মুশফিক অবশ্য কালও ছিলেন। পারিবারিক কাজে দুপুরেই একাডেমি ভবন ছেড়ে যাওয়ার সময় জাতীয় দলের অধিনায়ক বলে গেলেন, ‘এ ধরনের সেশন করলে মানসিকতায় কিছু পরিবর্তন তো আসেই। এখানে এমন অনেক টেকনিক শেখানো হচ্ছে, যেগুলো মানসিক শক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে।’
ইমরুল কায়েস এর আগে নিজ উদ্যোগে কোয়ান্টাম মেথড করেছেন। সেটির সঙ্গে আজহার আলীর ক্লাসের মিল খুঁজে পাচ্ছেন এই ওপেনার, ‘কোয়ান্টাম মেথড করে আমি উপকৃত হয়েছিলাম। এবারও উপকার পাব আশা করি। তবে উনি যে কৌশল শেখাচ্ছেন, সেগুলো নিয়মিত প্র্যাকটিস করতে হবে।’ এই ক্লাসের একটা ব্যাপার জাতীয় দলের আরেক ব্যাটসম্যান মুমিনুল হকের বেশ মনে ধরেছে, ‘কেউ বলল, আর আমি শুনলাম…শুধু তা নয়। নিজেকে সত্যি সত্যি শীর্ষস্থানে দেখা, এটিকে মনে গেঁথে নেওয়া—এই জিনিসগুলো শেখা দারুণ কাজে দেবে।’ সমালোচনা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার ওষুধও খুঁজে পাচ্ছেন তিনি এখান থেকে, ‘অনেক সময় আমাদের অনেক খারাপ কথা শুনতে হয়। সেগুলো কীভাবে ইতিবাচকভাবে নিতে হবে, সেটাও এখানে শেখানো হচ্ছে।’
আজহার আলীর সারকথাও এটিই, ‘আগুন দিয়ে দুনিয়া জ্বালিয়ে দেওয়া যায়, আবার আগুন দিয়েই হতে পারে সভ্যতার বিকাশ। সবকিছু নির্ভর করছে আপনি কীভাবে জিনিসটাকে ব্যবহার করলেন তার ওপর।