চিয়ার গার্ল দিয়ে ক্রিকেট (ভিডিও সহ)

0

IPL-2013-Cheerleaders-2১৯৮৩’র সেই দিনগুলি আজও বড়ই মধুর। বিশ্বের ক্রীড়াঙ্গনে ভারতের পতাকা ব্রিটিশদের গাঢ় নীল আকাশে সেদিন পতপত করে উড়েছিল। দিনটা ছিল ২৫ জুন। জগৎ সভায় ফের শ্রেষ্ঠ আসনে সেদিন বসেছিল ভারত। আর ভারতীয় ক্রিকেটের সেই বিশ্ব জয়ের অদৃশ্যপূর্ব ঘটনায় এদেশের সমাজ জীবনে নতুন এক ধর্মের জন্ম দিয়েছিল। যে ধর্মে দীক্ষিত হন এদেশের কোটি কোটি মানুষ। ‘ক্রিকেট ধর্ম’তে আন্দোলিত হয় গোটা দেশ। আর নতুন এই তরঙ্গের কম্পনে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় বিনোদনের অন্য সব মাধ্যম। নতুনভাবে জাঁকিয়ে বসা ওই ‘উন্মাদনা’ সময়ে আবর্তে আজ গ্রাস করেছে গোটা সমাজকে। ক্রিকেটের অনিয়ন্ত্রিত করাল থাবায় দেশ আজ বিপন্ন। অসহায়।

আসলে ক্রিকেটটা এদেশে তিরাশির পর রাতারাতি এক লাফে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় সকলের অজান্তেই। ‘কুম্ভকর্ণ’-র মত ঘুমিয়ে থাকা এই খেলাটা হঠাৎই যেন জেগে ওঠে। ‘রাজার খেলা’ হয়ে ওঠে সবার খেলা। আর মাঠের খেলাকে পেশায় পরিবর্তন করে শুরু হয় বাণিজ্য। ক্রিকেটকে বাজারে বিক্রি করে শুরু হয় আমদানি। খেলার আসল চেহারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ভারতীয় বোর্ড ক্রিকেটের মাদকতায় বুঁদ করে দিতে সফল হয় এদেশের সাধারণ আমজনতাকে। ফলে এর হাত ধরেই স্বাভাবিক নিয়মে পর্দার পেছনে গজিয়ে উঠে কালো টাকার রমরমা বাণিজ্য। ক্রিকেটের সাদা পোশাকে ফিঙ্ংি আর বেটিং-এর কলঙ্ক এই খেলার স্বচ্ছতাকে একেবারেই তলানিতে নিয়ে আসে। দগদগে ক্ষত এখন অসহনীয় যন্ত্রণায় পরিণত।

ক্রিকেটে বহু কিংবদন্তির জন্ম দিয়েছে ভারত। মনে পড়ে এই পুরোনো দিনের কথা। সে সময় ছিল না টেলিভিশন। রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনে শুনে চোখ বন্ধ করে সুনীল গাভাস্কর, গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের খেলা কল্পনা করতে হতো ক্রিকেট প্রেমীদের। ত্রিপুরার মত প্রত্যন্ত রাজ্য থেকে বেরিয়ে কলকাতা, দিলি্ল, বোম্বে, মাদ্রাজে খেলা দেখার সামর্থ ক’জনের ছিল? ফলে রেডিওই ছিল আমাদের ভরসা। আর একদিন পরের সর্বভারতীয় খবরের কাগজ বিশেষ করে কলকাতা থেকে আসা বাংলা কাগজে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতেন সকলেই। সেখানে দু’একটা ছবিতে গাভাস্করের ব্যাট তুলে দাঁড়ানো বা বিশ্বনাথের স্কোয়ার কাট-এর একটা মুহূর্ত। এই তো ছিল ক্রিকেট। সে সময় সিনেমার হলগুলিতে সিনেমা শুরুর আগে অল্প সময়ের জন্য দেখানো হতো ক্রিকেটের ক্লিপিংস। মানে ভারতে কোনও ক্রিকেট সিরিজ হলে, কোন একটা টেস্ট ম্যাচের কয়েক মিনিট দেখানো হতো ডকুমেন্টারি হিসেবে। খেলার ওই সামান্য মুহূর্তগুলি দেখার জন্যে সে সময় সিনেমা হলে উপচে পড়তেন ক্রিকেট প্রেমীরা। এটা কিন্তু ঘটনা। সেই ক্রিকেটের প্রতি সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা ছিল ফ্যানদের। অবশ্য সেই দিনগুলি এখানকার প্রজন্মের কাছে বোকা বোকা বলেই মনে হবে। হতে পারে। কিন্তু বাস্তব তো বদলানো যায় না।

আসলে ক্রিকেট যখন পয়সার মুখ দেখিয়েছে, তখন থেকেই এই খেলাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজারি পণ্য। আবেগ হয়তো রয়েছে। কিন্তু বাণিজ্যের কাছে সেই আবেগও একেবারেই বিকিয়ে গেছে। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই ক্রিকেটের বাণিজ্যে ঢুকে গেছে বেটিং। জুয়া যে শুধু ক্রিকেটেই_ তা তো নয়। জুয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি সেই আদিকাল থেকেই এদেশে ছিল। আজো রয়েছে। বিভিন্ন মহাকাব্যের পাতা উল্টে দেখলে আমাদের কাছে স্পষ্ট_

বিভিন্ন পদ্ধতিতে আদিকালেও জুয়া হতো। মহাভারতের সময়ের দাউদ ইব্রাহিম হিসেবে শকুনি মামাকে বললে কি ভুল কিছু বলা হবে? শকুনির চালে ব্যাটা যুধিষ্ঠির পর্যন্ত প্রকাশ্যে জুয়ায় তার বিবাহিত স্ত্রী দ্রৌপদীকে বাজি রেখে হেরেছিলেন। এর ফলে সমস্ত জ্ঞানীগুণী বিদগ্ধজনে ভরা সভায় বস্ত্রহরণের নাটকটা মঞ্চস্থ হয়েছিল। সবই বেটিং কেলেঙ্কারি। মহাকাব্যের সেই প্লটগুলি আজকের সমাজ জীবনেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

এবার আসা যাক ফিঙ্ংি-এ। জীবনের যেসব ক্ষেত্রে মানুষ বাঁকা পথে লাভালাভের গন্ধ পায় সেখানেই প্রয়োগ হয়। ফিঙ্ংি-এর। ফিঙ্ংি আকছার দেখা গেছে সেই আদিকাল থেকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজন্য আমলের ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, প্রত্যেক রাজাই ফিঙ্ারদের যন্ত্রণায় ভীষণভাবে কাবু ছিলেন। ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্যে ‘গদ্দারি’ পেশায় নিযুক্ত হতেন অনেকেই। রাজার খবর, রাজ অন্তঃপুরের খবর পাচারে বিশাল ইনাম পাওয়া যেতো। শুধু কি তাই? রাজ অন্তঃপুরে খবর চালাচালিতে খবরের কারবারিরাও তো এক ধরনের ফিঙ্ারই ছিল। বিভীষণ থেকে মীরজাফর আর আজকের শ্রীশানত্দ_ সবই সময়কাল পাত্রভেদে নতুন মাত্র শুধু, তাই না? সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বিশ্বজয়ের পর ভারতে ক্রিকেটের বাণিজ্যটাকে ধরে ফেলেন ভারতীয় বোর্ডে বণিক বাংলার মারোয়ারি কর্তা জগমোহন ডালমিয়া। চার বছরের মধ্যেই ভারতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজনের দায়িত্ব তুলে আনেন তিনি। বিট্রিশদের গুঁই গুঁই শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। ভারতের সঙ্গে জগুদা দক্ষিণ এশিয় লবীকে হাতে নিয়ে আয়োজনের দায়িত্বে জুড়ে দেন পাকিস্তানকেও। সে সময় ধীরুভাই আম্বানি সবে মাত্র ‘রিলায়্যান্স’ কোম্পানিটাকে বাজারে ঢোকানোর ছক কষছিলেন। ধীরুভাই খুঁজছিলেন একটা সলিড মাধ্যম। পেয়েও গেলেন ‘ক্রিকেটের বিশ্বকাপ’। ডালমিয়া-আম্বানি জুটির সেই ব্যান্ড গোটা দক্ষিণ এশিয় উপমহাদেশে ক্রিকেটকে ঢুকিয়ে দেন একেবারে ড্রয়িং রুমে। ব্যাস্ কেল্লা ফতে।

ভারতে বিশ্ব কাপ ক্রিকেটের সফল আয়োজনের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ডালমিয়াকে। ক্রিকেট হয়ে উঠে ‘সোনার খনি’। যেভাবেই ক্রিকেটকে ব্যবহার করা গেছে সেভাবেই দ্বিগুণ, চারগুণ হয়ে সেই টাকা বোর্ডের ঘরে ঢুকেছে। কয়েক বছরেই ভারতীয় বোর্ড হয়ে যায় বিশাল লাভজনক এক সংস্থা। আর বোর্ডের ‘আঙুল ফুলে কলা গাছ’ চেহারা দেখে রাজনীতির কারবারিদের কচকচানি শুরু হয়ে যায়। ঢুকে পড়ে ‘অন্ধকার দুনিয়ার’ কারবারিাও। ক্রিকেট হয়ে দাঁড়ায় পৃথক বিশাল এক ‘শিল্প’। ক্রিকেটকে ঘিরে সাজতে শুরু করে সমাজ। গ্ল্যামার দুনিয়াও ঝুঁকে পড়ে ‘ক্রিকেট শিল্পে’। দেশের বড় বড় সব বণিকরা স্পন্সরশিপের ঝুলি নিয়ে ক্রিকেটের পেছনে ঘুরতে শুরু করেন। এতসব কিছুর টানে কখন যে ক্রিকেট বাণিজ্যটা অন্ধকার দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যায় সেচা আঁচ পর্যন্ত করতে পারেন নি বোর্ডের তথাকথিত জাঁদরেল প্রশাসকরা।

একটা সময় নেতার ভারে নুইয়ে পড়া ভারতীয় ক্রিকেট দলের চেহারায় পরিবর্তন আনার জন্যে মুহম্মদ আজহার উদ্দিনের হাতে বোর্ড নেতৃত্বের ক্ষমতা দেয়ার পর ফিঙ্ংি আর বেটিং-এর বাণিজ্যের করিডোর উন্মুক্ত হয়। চতুর আজহার শুরুটা চমৎকার করেন। কিন্তু যখন বুঝে ফেলেন তিনিই দলের সর্বেসর্বা তখন থেকেই ডি-কোম্পানির কাছে ক্রিকেটটা বিকিয়ে দেন। হ্যান্সি ক্রোনিয়ের মত ভাল মানুষকে যেভাবে জালে ফেলা হয়েছিল সেই ওয়ান ওয়ে থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ ক্রিকেটরটিকে শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়েছিল। আজহারের জুয়াটা অবশ্য শুরু হতো শচীন আউট হওয়ার পর। শচীন ব্যাট হাতে মাঠে যতটা সময় ছিলেন ততক্ষণ কোনও জুয়া হতো না। কারণ যে কোনও ম্যাচ যে কোনও জায়গা থেকে একা বের করে নেয়ার ক্ষমতা ছিল সে সময়কার ছোট্ট সেই ছেলেটির। আর শচীন আউট হলে প্রতি ওভারে প্রতি বল-এর চলতো বেটিং। মাঠে বসেই হয়ে যেতো ফিঙ্ংি। যে কারণে শেষ পর্যন্ত প্লেয়ার্স ড্রেসিং রুমে একটা সময়ের পর মোবাইল নিষিদ্ধ করেছিল ভারতীয় বোর্ড।

মনে পড়ে সেই সময়ের কথা। ত্রিপুরা ক্রিকেট সংস্থার বস্ সমীরণ চক্রবর্তী বোর্ডের সঙ্গে বহু ঝামেলা করে আগরতলায় সে সময়ে দেওধর ও উইলস্ ট্রফির ম্যাচ প্রথমবারের মতো আগরতলা এনেছিলেন। যার দৌলতে ভারতীয় নক্ষত্রদের মহারাজা বীর বিক্রম স্টেডিয়ামে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল এ রাজ্যের ক্রীড়াপ্রেমীদের। সেটা এ রাজ্যের ক্রিকেটেরও স্বর্ণযুগ বলা যায়। সেই সব আসরের একটিতে আগরতলায় খেলার কথা ছিল আজহারেরও। সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু কলকাতা বিমান বন্দর পর্যন্ত এসে আজহার আর আগরতলার বিমানে চাপেন নি। ফিরে যান মুম্বাই-এ। এ নিয়ে মাঠে ঝামেলা কম হয়নি। বঞ্চিত দর্শকরা ‘হায় হায়’ ধ্বনি দেন। প্লে কার্ডে গালাগাল দেন। মাঠে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করেন। কিন্ত কেন আজহার আগরতলায় বিমানে চাপেন নি সেই রহস্যটা অনেকেই জানতেন না। পরে জানা গেছে, আগরতলায় সে সময় মোবাইল পরিসেবা ছিল না সেটা কলকাতা এসে জানতে পেরে তিনি ফিরে গেছেন ! ভাবুন একবার। আসলে আজহার যেভাবে নেটওয়ার্কটা তৈরি করেছিলেন ২৪ ঘণ্টা সেটা মোবাইলেই চলতো। মুম্বাই-এর কোলাবায় ‘তাজ হোটেল’-এর আজহারের জন্য একটা ঘর ৩৬৫ দিনের জন্য বরাদ্দ ছিল সে সময়। শোনা কথা, সেখান থেকেই নাকি নেটওয়ার্ক চলতো। ৩৬৫ দিন তাজ-এ ঘর ভাড়া দিয়ে সাদা টাকায় কি চলা সম্ভব?

শরদ পাওয়ার ক্রিকেটে ঢোকার শামিল হওয়ার পর রাজনীতি আর মাফিয়ার যুগলবন্দিতে নতুন চেহারা পায় ক্রিকেট। পাওয়ারের ‘পাওয়ার’ পলিটিঙ্ েসব ধরনের নোংরামি জুড়ে যায়। বোর্ডের নির্বাচনে ভোট কেনা বেচার নগ্ন চেহারা বেরিয়ে আসে। অত্যন্ত কুৎসিত ওই চেহারায় বোর্ডের ভাবমূর্তি ম্লান করে দেয়। অবশ্য জগুদাও পিছিয়ে ছিলেন না। ক্ষমতা দখলের জন্যে বোর্ডের সংবিধানের ফাঁকফোকরগুলি শ্রীহীনভাবেই ব্যবহার করেন তিনি। লবিবাজির খেলায় শরদ পাওয়ার প্রথম ধাক্কায় তীরে এসে তরি ডোবালেও পাওয়ারের দ্বিতীয় ধাক্কা আর সামলাতে পারেন নি জগুদা। একেবারে ক্লিন বোল্ড হন। আর বোর্ডের ক্ষমতা দখরের ওই খেলায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলিকে তাবড় সব পলিসি মেকারদের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল রীতিমত লজ্জাকর। সোনিয়াজি থেকে অরুণ জেটলি, লালু থেকে মোদি, বুদ্ধবাবু কে ছিলেন না সে সময়।

ভারতীয় বোর্ডের পাশাপাশি ক্রিকেটের কালো টাকার রমরমা বাণিজ্যে চোখ বন্ধ করে পা বাড়িয়ে দেয় পাকিস্তানিরা। ফিঙ্ংি, বেটিং-এর ক্যান্সারে ওই দেশটি সর্বকালের রেকর্ড গড়ে নেয় অল্প সময়ে। আর ক্রিকেটের কালো কারবারির রাজধানী হয়ে দাঁড়ায় মরু শহর শারজা। সেখানে ক্রিকেটের বোলিং ফিঙ্ংি-এর নিয়ন্ত্রক ছিলো সেই ডি-কোম্পানি। ছিল বললে ভুল হবে, এখনো রয়েছে। শারজা’র ক্রিকেট এক সময় ছিল দক্ষিণ এশিয় দেশগুলির কাছে আকর্ষণীয় আসর। কিন্তু একটা সময় পর ক্রিকেটারকে ওই মরু শহরে যেভাবে প্রহসন বানিয়ে দেয়া হয়েছিল এতে ভারতীয় বোর্ড বাধ্য হয়েছে সেই শহরে ক্রিকেটে দল পাঠানো বন্ধ করে দিতে। শারজা এখন অতীত। অথচ এই শহরে শচীন টেন্ডুলকারের সেই অসাধারণ শতকটি আজও ক্রিকেট প্রেমীদের হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে। হয়ে থাকবে অবিনশ্বর।

ইন্ডিয়ান প্রিশিয়ার লিগ (আইপিএল) চালু হওয়ার পর ফিঙ্ংি আর বেটিং-এর বাণিজ্যে আরো তেজি ভাব আসে। ডি-কোম্পানি’র কাছে এসে যায় বিশাল সুযোগ। ফলে আইপিএল প্রথম আসর থেকেই বিতর্কের মধ্যে পথ চলা শুরু করে। ষষ্ঠ আসর পর্যন্ত সেই বিতর্কের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। এই আসরটিকে কোনোভাবে আর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। কারণ আইপিএল-এ ক্রিকেট থেকেও ক্রিকেটের বাইরের বিষয়গুলি জড়িয়ে রয়েছে বেশি। ক্রিকেটের সঙ্গে বলিউড, আইটেম গার্ল, চিয়ার, লেডি, কালো টাকা, জুয়া, নাইট পার্টি এসবের সমন্বয়ে এক অদ্ভূত রূপ নিয়েছে। এই চেহারায় ক্রিকেটটা শুধুই নামেই রয়েছে। আইপিএল-এ খেলা কোথায়? এ প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে।

ক্রিকেটের এ ধরনের ফরম্যাটে খেলার নামে জুয়া আর কালো টাকা হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো স্বাভাবিক নিয়মেই এসে পড়েছে। এখানে খেলাটা কোন মুখ্য নয়। লক্ষ্য একটাই ‘মানি পল্টি প্লাই’ করা। সেটা সৎ উদ্দেশ্যে যতটা না হয়, এর ঢের গুণ বেশি হয় বাঁকা পথে। তাই ক্রিকেটের নামে এ ধরনের ‘ক্যাসিনো’তে কালো টাকা উড়বে সেই তো স্বাভাবিক। এই বাণিজ্যটা এদেশে ডি-কোম্পানি বা এ ধরনের আন্ডার ওয়ার্ল্ড-এর বসরা নিয়ন্ত্রণ করবে এমনটাই তো হওয়ার কথা। ইচ্ছেও। ফলে আইপিএল-এর নামে যা চলছে এ ধরনের আসলে বিতর্ক এড়ানো কোনোভাবেই আর সম্ভব নয়।

প্রশ্নটা তাই স্বাভাবিক কারণেই আসে, তাহলে কি আইপিএল বন্ধ করে দেয়া উচিত? এমন প্রশ্ন যে উঠে নি তা কিন্তু নয়। প্রশ্নটা তো এমনও আসতে পারে, আইপিএল বন্ধ হলেই কি ক্রিকেটের জুয়াড়ি’রা তাদের ধাক্কা বন্ধ করে হাত গুটিয়ে নেবেন? আসলে এ বিষয়টা নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা করতে হবে। জুয়াড়ি’রা কি করছেন এর জন্য আইপিএল দায়ী নয়। দায়ী আইপিএল-এর আয়োজনের ক্ষেত্রে পদ্ধতিটা। বাহারি চমক বন্ধ করে দিয়ে খেলাটার উপর গুরুত্ব বেশি দিলে সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। পাঠকরা ভাবুন একবার, টেস্ট ক্রিকেটে কতটা বেটিং বা ফিঙ্ংি হয়। আদৌ কি সেভাবে হয়? কেন? আসলে ক্রিকেটের কুলিন এই ফরম্যাটে খেলাটাই বেশি হয়, বাহারি চমক নয়। তাই টেস্ট ক্রিকেট এখানো অনেকটাই কলঙ্কমুক্ত। ঠিক সেই চিন্তায় গিয়ে একদিনের সীমিত ওভারের ক্রিকেট আর এখানকার টি-২০’তে ক্রিকেটকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যেখানে ক্রিকেটটাই প্রাধান্য পাবে বেশি। ‘চিয়ার গার্ল’ না। গ্ল্যামার দুনিয়ার ‘বাকোয়াজ’ ড্রামা বন্ধ করতে হবে। মাঠের ভেতরে বলিউডের ওইসব ড্রামাবাজদের সস্তা নাটক বন্ধ করতে হবে। এ কেমন কথা? ক্রিকেট থেকেও আইপিএল-এর সিংহভাগ শিরোনাম হয় শাহরুখ, শিল্পা, প্রীতি, বিজয় মালিয়া, নীতা, আম্বানি, সুব্রত রায়দের নিয়ে। মাঠের ভেতরে তাদের ড্রামাবাজিগুলোই যেন মূল আকর্ষণ। এসব বাজারি বিষয়গুলোকে ছেঁটে ফেলতে না পারলে আইপিএল-এর বেটিং আর ফিঙ্ংি-এর বিশাল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব।

শুধু ক্রিকেট কেন, গোটা বিশ্বে সমাজ ব্যবস্থায় ভাল দিকগুলি যেমন রয়েছে, ঠিক ততটাই রয়েছে বাজে বিষয়গুলিও। কোনো কোনো দেশে বেটিংটা তো আইনিভাবে স্বীকৃত। তাই ক্রিকেট, ফুটবল বা বিনোদনের যে কোনও মাধ্যমে বিশেষ করে সমাজের যে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বা সংযোগ রয়েছে সেখানেই অন্ধকার জগতের বিচরণ বেশি দেখা যায়। এখন ক্রিকেট যেমন এদেশের মানুষের কাছে ড্রইং রুমের আলোচনার বিষয়, তাই ক্রিকেট আন্ডার ওয়ার্ল্ড-এর থাবা বা ক্রিকেটে কালোটাকার খেলা বেশি হবেই। সহজে মানি মাল্টিপ্লাই করার ধান্দায় জড়িয়ে পড়েছে একটা বিশাল চক্র। ক্রিকেটের পরিবর্তে ফুটবল যদি এ ধরনের জনপ্রিয়তা এদেশে পেতো তো সেখানেই আগ্রহ দেখাতো অন্ধকার জগতের কারবারিরা। আদিকাল থেকে এই ধারা চলছে, চলবেও। কোনো আইন দিয়ে বেটিং বা ফিঙ্ংি নির্মূল সম্ভব নয়। তাই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে ভাবতে হবে ক্রিকেটের মাঠে ক্রিকেট-টা যেন বেশি গুরুত্ব পায়। অক্রিকেটীয় বিষয়গুলি নয়। আর কতো টাকা চাই বোর্ডের? গোটা বিশ্বে ভারতীয় বোর্ডের মত অতি লাভজনক সংস্থা ক’টা রয়েছে? ক্রিকেটের মাঠে তাই এখন ক্রিকেটটাই চলুক। আইপিএল-এর নতুন দিশা দিক ভারতীয় বোর্ড। সামগ্রিক চাপের কাছে সেটা কতটুকু সম্ভব সেটাই ভাবনার বিষয়। তথাকথিত ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে জাহির করা এদেশের রাজনীতির কারবারি আর বেনিয়াদের সম্মিলিত চাপের কাছে ভারতীয় বোর্ডের কর্তারা ক্রিকেটটাকে আদৌ কতটা বাঁচাতে পারবেন প্রশ্ন এখানেই।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More