ঢাকা: ফজরের আযানের ধ্বনির সাথেই ঘুম ভাঙে মালার। তারপর টাইম কলের পানি ধরে রাখার পালা মালার। মিরপুর রূপনগর সাবলেটে বাসায় ভাড়া থাকেন লিবার্টি ফ্যাশন গার্মেন্টস এর অপারেটর মালা। ঘুম থেকে উঠেই প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধে নামতে হয় তাকে। মালার বয়স এখন ২৮।
কিন্তু এই যুদ্ধ চলছে গত প্রায় ১৮ বছর ধরে। ১০ বছর বয়স থেকে এই লিবার্টি ফ্যাশনে কাজ নিয়েছিলো চাদপুরের মালা। মাসে বেতন পান ৬ হাজার ৮শ টাকা। বাড়ি ভাড়াই চলে যায় ৫ হাজার টাকা। কারখানায় পৌছাতে হয় সকাল সাড়ে সাতটায় মধ্যেই। রূপনগর থেকে প্রতিদিন হেঁটে কর্মস্থলে আসনে মালা। স্বচ্ছল মানুষরা যখন সকালে মর্নিং ওয়াকে বের হন তখন মালা পেটের দায়ে অর্থাভাবে প্রতিদিন সকালে ৪০ মিনিট থেকে ৪৫ মিনিট হাটেন কারখানায় যাওয়ার জন্য।
কারখানা পৌঁছানোর পরই হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর। তারপরই কাজ শুরু। বেতন বেড়েছে তাই কাজের লক্ষ্যমাত্রাও বেড়েছে শ্রমিকদের। জানান মালা। বলেন, আফা যেখানে আমরা ২০ পিস মাল বানাইতে পারুম এক ঘন্টায় সেইখানে এখন ২৫ পিস থেকে ৩০ পিস মাল বানানোর টার্গেট দেয়। কিন্তু আমরা অনেকেই তা পারি না। তখন অকথ্য ভাষায় সুপারভাইজাররা গালাগাল করে। কিন্তু কী করমু কাজ যেহেতু করি তাই কিছুই বলা যায় না।
কারখানার সাধারণ সময়সীমা বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত। কিন্তু প্রতিদিনিই গড়ে প্রায় এক ঘন্টা থেকে দেড় ঘন্টা বেশি কাজ করতে হয় মালাকে। এই এক-দেড় ঘণ্টার পায় কোনো ওভারটাইম। নাই বাড়তি কোনো পারিশ্রমিক। সন্ধ্যা সাতটার পর মালা যদি কাজ করে তাহলে কিছু টাকা ওভারটাইমের টাকা যোগ হয় বেতনের সাথে।
ওভারটাইম মালা করতেও চায়। কারণ যে বেতন পায় তাতে সংসার চলে না। একা মানুষ। স্বামী ছেড়ে চলে গেছে প্রায় দুই বছর। ছোট বেলা থেকে কাজ করে জমানো আড়াই লাখ টাকা ব্যবসা করতে দিয়েছিল স্বামীকে। সেই টাকা নিয়ে স্বামী বিশ্বাস রাখতে পারেনি মালার।
কষ্টের মধ্যে জীবন চলছিল। হঠাৎ জানতে পারে কারখানা প্রায় বন্ধ হতে বসেছে। ওভারটাইমতো দূরের কথা আট ঘন্টা কাজও করাচ্ছে না মালিকপক্ষ। গত দুই মাস যাবৎ পাচ্ছে অর্ধেক বেতন। এক সময় মালার বাবা-মাকে টাকা দিয়ে সহায়তা করত। আর এখন বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা আনতে হচ্ছে। এতে যেন এক রকম লজ্জায় পেল মালা।
বলেন, যা টাকা জমাইছিলাম জামাইয়ে দিছি। সে টাকা নিয়ে জুয়া খেলে সব নষ্ট করছে। পরে যখন আমি আর টাকা দিতে পারিনা আমারে ছাইড়া চইলা গেছে। কারখানায় কাজ নাই দেইখা আমাগো গত দুই মাস যাবৎ অর্ধেক টাকা দিতাছে মালিক। বিকালের আগেই ছুটি দিয়া দেয়। এই অর্ধেক টাকায় কী আর জীবন চলে। এই মাসেও বাবা মায়ের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা আনছি। এই বয়সে বাবা-মার কাছ থেকে টাকা আনতে লজ্জা লাগে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ি, রানা প্লাজা ধ্বসের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়েছে ৫০ হাজার শ্রমিক। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে প্রায় ৫ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে আরো অনেক কারখানা। লিবার্টি কারখানাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর ফলে চিন্তিত হয়ে পড়েছে মালা ও মালার মতো আরো অসংখ্য শ্রমিক।
দুপুরের পর লিবার্টি ফ্যাশন বন্ধ হয়ে যায়। বেতন যেহেতু অর্ধেক তাই এখন আর দুপুরেও খাওয়া হয় না মালার। শুকনো মুখে বাড়ি ফিরে মালা। নিঃস্ব। একা। গত দুই মাস যাবৎ রাতে কেবল আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে সেরে নিচ্ছে খাবার।
নতুন কোনো কারখানায় কাজ খুঁজছে মালা। কথাও বলেছে কয়েকটিতে। হয়তো সামনের মাসে কোনো নতুন কারখানা থেকে ডাক পাবে সেই আশায় বুক বেধে আছে মালা।
প্রতিবছরই একটি করে মে দিবস যায়। মালারা একদিনের ছুটিও পায়। কিন্তু ভাগ্যেও পরিবর্তন হয় না মালাদের।