বিএনপির শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে রদবদল চান দলের পরবর্তী কর্ণধার তারেক রহমান। যাদের কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেনি, শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেছে, তাদের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ দলের এই সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আন্দোলনে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে থেকেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েও যারা কোনো ভূমিকা না রেখে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন কোনো রকমের রাখডাক না রেখেই তাদের সংশ্লিষ্ট পদ থেকে অপসারণ চান তিনি। পরবর্তী চূড়ান্ত আন্দোলনের আগেই বিএনপিতে এ ব্যাপারে একটি নীরব শুদ্ধি অভিযান চালানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। তবে যাদেরকে রদবদল করা হবে তাদের একেবারে বাদ না দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদে পুনর্বাসনের চিন্তাভাবনাও করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বিএনপিসহ যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া বিএনপির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি লন্ডন ঘুরে আসা বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা ও একজন সাবেক মন্ত্রী জানান, বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরের আন্দোলনে শীর্ষস্থানীয় পদে থেকেও যারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে সারা দেশে যখন আন্দোলন তুঙ্গে ছিল এবং সারা দেশ থেকে রাজধানী প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখন ঢাকার আন্দোলনের দায়িত্বে থেকেও যেসব নেতা পলাতক ছিলেন, সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীদের বিপদের মুখে ফেলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্তও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন_ তাদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন দলের এই দ্বিতীয় প্রধান নেতা। ফলে তিনি এসব ব্যর্থ নেতাদের আর দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখতে চান না। আর কোনো তল্পিবাহক নয়, জিয়া পরিবার, বিএনপি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের আস্থাভাজন, সাংগঠনিকভাবে দক্ষ, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদেরই গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখতে চান। গত পাঁচ মাসে এ সংক্রান্ত একটি তালিকাও তৈরি করেছেন তারেক রহমান। এ তালিকায় সাম্প্রতিক আন্দোলনে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব থেকে শুরু করে স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তাদের কার কী ভূমিকা ছিল এবং এখন তারা কে কী ভূমিকা রাখছেন_ সেসব আমলনামা স্থান পেয়েছে। জানা গেছে, এর মধ্যে দলের শীর্ষ নেতাদের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে বার বার আত্দগোপনে চলে যাওয়া থেকে শুরু করে বোরকা পরে আদালতে যাওয়া, হেলমেট পরে মাথা ঢেকে কর্মীদের পিছনে মোটরসাইকেলে চড়ে রাজপথে ঘুরে বেড়ানো থেকে শুরু করে স্থায়ী কমিটির জনৈক সদস্যের মুখে নকল দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে হাইকোর্টে অবস্থান করা ইত্যাদি সব তথ্যই তারেক রহমানের কাছে আছে। শীর্ষ নেতাদের এমন কর্মকাণ্ড শুধু অন্দোলনকে ব্যর্থই নয়, বরং পুরো দেশবাসীর কাছে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং হাস্যরসে পরিণত করেছে বলে মনে করছেন বিএনপির এই ‘সেকন্ড ইন কমান্ড’। সাম্প্রতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা শীর্ষ নেতাদের কার কী ভূমিকা সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ শেষে খুব শীঘ্রই নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলেও আভাস পাওয়া গেছে। বিশেষ করে দল করার সুবাধে যেসব নেতা অগাধ অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, একেকজন একেকটি করে ব্যাংক-বীমা কোম্পানির মালিক বনে গেছেন। তাদের বেশিরভাগই এখন নিজেদের সম্পদের এই পাহাড় রক্ষায় ব্যস্ত। এ বিষয়টিই সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির একজন অন্যতম সদস্য দলীয় চেয়ারপারসনসহ কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর সামনে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। ‘মুখে মুখে দলের কথা বলে মিডিয়ায় কভারেজ নিলেও তলে তলে সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলছেন’ এমন নেতাদের বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন তারেক রহমান। আর দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এরকম হাতেগোনা কয়েকজন নেতার বিষয়ে বিশ্বস্ত নেতাদের ইতিমধ্যেই সতর্কও করে দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে নিকটাত্দীয়-পরিজনের সঙ্গবিহীন বেগম খালেদা জিয়ার একাকিত্বের সুযোগ নিয়ে যারা তার চারপাশে থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত করে তাকে শুধু কিছু রোটিন-ওয়ার্কের মধ্যেই ব্যস্ত রেখে নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন, তাদের ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখছেন দলের এই ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দক্ষ, যোগ্য ও দলীয় নেতা-কর্মীদের বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থাভাজন ব্যক্তিদের দায়িত্ব প্রদানের আশা ব্যক্ত করে দলের কেন্দ্রীয় স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, আমরা আশা করছি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং আমাদের নেতা তারেক রহমানের কাছ থেকে অচিরেই এসব ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত আসবে। উপযুক্ত লোককেই প্রয়োজনীয় দায়িত্বে দেবেন তারা। তিনি আরও বলেন, বেগম খালেদা জিয়া আর তার পরিবারের সদস্যদের চেয়ে বেশি ভুক্তভোগী তো বিএনপিতে আর কেউ নেই। দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এখন বাড়ি ছাড়া। তার সন্তান ও
নাতি-নাতনিরা সবাই তার চোখের আড়ালে। এ অবস্থায় তিনি দলটাকে ধরে রেখেছেন। কাজেই তিনি তো আর দলের অমঙ্গল চান না। এদিকে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান এখন মালয়েশিয়ায় অস্থান করছেন, সেখানে ছোটোভাই আরাফাত রহমানের সঙ্গে দেখাও হয়েছে। মা বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার্থে সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা ছিল। তাই তারা আশায় ছিলেন_ মায়ের সঙ্গে পুরো পরিবার মিলিত হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও বোধহয় আর হয়ে উঠছে না, দলের অভ্যন্তরীণ একটি চক্রের পরোক্ষ ষড়যন্ত্রের কারণে। কারণ তারা চান না যে, তারেক রহমানের সঙ্গে সহসাই বেগম খালেদা জিয়ার দেখা-সাক্ষাৎ হোক। এতে বিএনপির চলমান ‘রাজনীতির গণেশ পাল্টে যেতে পারে’। ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে_ নিজেদের সাজানো সব সুযোগ-সুবিধা আর আরাম-আয়েশের বাগান।