অপারেশন ব্লু স্টার : গোলাম মাওলা রনি

0

ronyঅপারেশন ব্লু স্টার। ১৯৮৪ সালে ৩-৮ জুন শিখদের তীর্থস্থান স্বর্ণ মন্দিরে এ অভিযান পরিচালনা করে ভারতীয় সেনারা। যা ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামে পরিচিত। এ অপারেশনের নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রার। পুরো পাঁচ দিন গোলাগুলির পর স¦র্ণ মন্দিরের নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী। ভারতের সরকার জানিয়েছিল এ অভিযানে নিহত হয়েছিলো ৪৯২ জন। বিধ্বস্ত হয়েছিল ঐতিহাসিক স্বর্ণমন্দির। শিখদের নেতা ভিন্দ্রানওয়ালার লাশ উদ্ধার করা হয় মন্দির থেকে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ইতিহাসে এটি একটি অন্ধকার অধ্যায়। চলতি মাসে পালিত হল স্বর্ণ মন্দিরে সেনা-অভিযানের ৩০ বছর পূর্তি।কেন এ অভিযান: শিখ ধর্ম বেশি দিনের পুরনো নয়। শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক জন্মেছিলেন পাঞ্জাবে, ১৪৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। আর মারা যান ৬৯ বছর বয়সে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে। শিখ শব্দের অর্থ হলো শিষ্য। গুরু নানকের শিষ্যরা খ্যাত হন শিখ হিসেবে। গুরু নানক বলতেন, ঈশ্বর এক এবং তিনি নিরাকার। তিনি হিন্দুদের জন্মগত জাতিভেদ প্রথা ও মূর্তিপূজাকে অস্বীকার করেন। শিখদের সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থ হলো গ্রন্থসাহেব। ১৯৪৭ সালে পাকিস্থান হয়ার সময় বাংলার মতো পাঞ্জাবও হয় বিভক্ত। পাঞ্জাবের হিন্দু ও শিখরা যোগ দেয় ভারত রাষ্ট্রে। আর মুসলিম প্রধান পশ্চিম পাঞ্জাব যোগ দেয় পাকিস্তানে। কিন্তু ভারতের পাঞ্জাবে (পূর্ব পাঞ্জাবে) শুরু হয় শিখ ও পাঞ্জাবি হিন্দুদের মধ্যে প্রবল বিরোধ। ভারতের পাঞ্জাবকে দু’টি ভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করা হয় ১৯৬৬ সালে। শিখপ্রধান ভারতীয় পাঞ্জাবের নাম থাকল পাঞ্জাব। অন্য দিকে সাবেক হিন্দুপ্রধান পাঞ্জাবের নামকরণ করা হয় হরিয়ানা, যা হর সাবেক পাঞ্জাবের দক্ষিণ-পূর্ব ভাগে অবস্থিত। একপর্যায়ে শিখরা হতে চায় স্বাধীন। শিখদের একটি অনুযোগ ছিল, ভারত ভাগের পর মুসলমানরা পেল পাকিস্তান, হিন্দুরা পেল হিন্দুস্থান, কিন্তু শিখরা পেল না কোন স্থানই। তারা গড়তে চায় শিখরাষ্ট্র খালিস্তান। ৭০ দশকে শুরু হয় এ আন্দোলন। গোড়ার দিকে এই আন্দোলন সহিংস না হলেও পরে এটা সহিংস রুপ নেয়।  শিখদের সবচেয়ে পবিত্র জায়গা হলো অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির। খালিস্তান আন্দোলনের নেতারা অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির থেকে খালিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। খালিস্থান আন্দোলনের আদিতে লঙ্গোয়ালের নেতৃত্বে গঠিত হয় ধর্মযুদ্ধ মোর্চা। যা পাঞ্জাবের জন্য নদীর জলের ভাগাভাগি, চন্ডিগড় হস্তান্তর ইত্যাদি দাবি তোলে পরের দিকে, অর্থাৎ ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন। এবং আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে নিয়ে যান। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির চত্বরে সচরাচর পুলিশ ঢোকা বারণ থাকায় চত্বর থেকে চলতে থাকে অবাধে জঙ্গি তৎপরতা। এ সহিংস আন্দোলন দমনে তৎকালিন ভারতের প্রধধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির আদেশে আন্দোলনের তীর্থ স্থান স¦র্ণ মন্দিরে ১৯৮৪ সালের ৩-৮ জুন সেনা অভিযান পরিচালনা করা হয়।

ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকান্ড-: ইন্দিরা গান্ধী নির্মমভাবে এ উঠতি আন্দোলনকে দমন করেন। কিন্তু এর বিনিময়ে তাকেও চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। দেহরক্ষী বিয়ন্ত সিং অপারশেন ব্লু স্টারের পর লাশের গন্ধে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন, সে বছরই অক্টোবরের শেষদিকে এক সকালে ইন্দিরার স্নিগ্ধ হাসির জবাবে স্যালুটের পর বিয়ন্ত সিং নিজের রিভলভার বের করে পাঁচবার গুলি করেন ইন্দিরা গান্ধীকে। সহকর্মী সতওয়ন্ত সিং ইন্দিরার ওপর মেশিনগানের ম্যাগাজিন খালি করেন। অন্যান্য দেহরক্ষীরা বিয়ন্ত সিংকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করে, আর সতওয়ান্ত সিং আহত হন। পরে সতওয়ন্তের ফাঁসি দেয়া হয়। গুলিতে আহত হয়ার পর দিল্লির জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীমতী গান্ধীকে। অস্ত্রোপচার করে তাঁর শরীরের উনিশটি বুলেটের সাতটি বের করা হয়। কিন্তু গুলি চালনার এক ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। ৩রা নভেম্বর মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থল রাজঘাটের নিকটস্থ শক্তিস্থল নামক স্থানে তার সৎকারক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

অপারেশন রোজউড: শ্রীমতী ইন্দিরার মৃত্যুর পরবর্তী চার দিনে ব্যাপক হিংসাত্মক ঘটনায় প্রাণ হারান সহ¯্রাধিক শিখ। এই ঘটনা ঘটে মূলত দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। এখানেই শেষ নয়, এই সেনা অভিযানের প্রতিবাদে ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর অনেক সেনাবাহিনী  ছেড়ে চলে যেতে থাকেন বিদ্রোহ দমনে গঠিত হয় ‘অপারেশন রোজউড’। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পাল্টা প্রতিশোধ নিতে দিল্লি এবং আশেপাশের এলাকায় ঘটে শিখ নিধনযজ্ঞ শিখদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় তিন হাজার শিখ নিহত হয় সেই দাঙ্গায়।

অভিযানের নায়ক ব্রারের ওপর হামলা: ১৯৮৪-র অপারেশন ব্লু স্টার অভিযানের নায়ক লেফটন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) কে এস ব্রারের ওপর প্রতিহিংসামূলক হামলা চালানোর হয়। যার দায়ে তিন শিখ পুরুষ ও এক মহিলাকে সাড়ে ১০ থেকে ১৪ বছরের কারাদ- দিয়েছেল ব্রিটেনের এক আদালত। আটের দশকে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরকে জঙ্গিমুক্ত করতে সেখানে সেনা অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্রার। এজন্য তার ওপর চরম আক্রোশ পুষে রেখেছিল খালিস্তানপন্থীরা। লন্ডনের এক রাস্তায় ব্রারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল খালিস্তানপন্থীরা। তার গলা কেটে নেয়ার চেষ্টা করেন তারা। রায়ে বিচারক বলেছেন, স্বর্ণমন্দিরে ব্রারের অভিযানের বদলা নিতেই তার ওপর হামলা চালানো হয়েছিল, এটা পরিষ্কার। বিচার পর্বে সওয়াল জবাবের সময় সরকারপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে ব্রার স্ত্রী মীনার সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। এ সময় তার ওপর হামলা চালানো হয়। ব্রাকে শিখদের পয়লা নম্বর শত্রু বলে তকমা দিয়েছিল একটি খালিস্তানপন্থী ওয়েবসাইট। এর আগে তাকে সাতবার হত্যার চেষ্টা করেছিল শিখরা। অভিযানে ব্রিটেনের সহায়তা: ভারতের অমৃতসরে শিখদের তীর্থক্ষেত্র স্বর্ণমন্দিরে ৩০ বছর আগে চালানো সেনা-অভিযানে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ভারতকে সাহায্য করেছিল বলে অভিযোগ করেছেন লেবার পার্টির একজন এমপি। তার এ দাবির পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এর তদন্তে নির্দেশ দিয়েছেন। বৃটিশ এমপি টম ওয়াটসন বলছেন, মার্গারেট থ্যাচারের আমলের সরকারি নথিপত্র যা সবেমাত্র জনসমক্ষে এসেছে তা দেখেই তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। এদিকে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামে ওই সেনা-অভিযানের ৩০ বছর পূর্তিতে অনেক শিখ সংগঠনই সেই ঘটনার তদন্ত দাবি করছেন। একই দিকে সে সময় বৃটিশ সরকারের প্রকৃত ভূমিকা কী ছিল, তা জানানোর দাবি তুলছেন। মি ওয়াটসন জানিয়েছেন, সম্প্রতি গোপনীয়তার বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর তিনি পুরনো সরকারি নথি ঘেঁটে দেখতে পেয়েছেন ওই প্রাণঘাতী অভিযানে বৃটিশ সরকার ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More