বিতর্কই তার ধ্যানজ্ঞান। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হয়েছে ৩০ বার। পেয়েছে চাঁদপুর সিডিএমের ‘প্রতিশ্রুতিশীল বিতার্কিক অ্যাওয়ার্ড’। চাঁদপুর সরকারি কলেজের ছাত্রী আফরোজা ইয়াসমিন চাঁদনীর গল্প শোনাচ্ছেন মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
তখন সবে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করা হলো বিতর্ক প্রতিযোগিতার। স্যাররা না জানিয়েই তার নাম লিখিয়ে দিলেন বিতর্কে। সেটাই ছিল প্রথম কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। বিতর্কে জিতল তার দল। সে-ই জিতে নিল শ্রেষ্ঠ বক্তার পুরস্কার। পুরস্কার হিসেবে মিলল বই ও সনদপত্র। তখন থেকেই বিতর্কচর্চা পুরোদমে শুরু। আফরোজা ইয়াসমিন চাঁদনী এখন চাঁদপুরের খ্যাতনামা বিতার্কিক।
পড়ছে চাঁদপুর সরকারি কলেজে। এ পর্যন্ত শতাধিক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হয়েছে ৩০ বার। তার নেতৃত্বে দল জিতেছে ২০ বারের বেশি। বিতর্কে ভালো পারফর্ম করার জন্য পেয়েছে চাঁদপুর ডিবেট মুভমেন্ট (সিডিএম)-এর ‘প্রতিশ্রুতিশীল বিতার্কিক অ্যাওয়ার্ড’।
আবৃত্তিতেও ভালো চাঁদনী। ২০০৭ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে জাতীয় শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় এবং ২০১২ সালে চাঁদপুর সরকারি কলেজের আয়োজনে আন্তঃকলেজ আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় সে। আন্তঃকলেজ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে ২০১১ সাল থেকে টানা তিনবার দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে চাঁদনী।
সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে চাঁদনী যুক্ত আছে টিআইবি ইয়েস গ্রুপ, পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলন, রোটারি ক্লাবের সঙ্গে। ২০১৩ সালে বিতর্ক, আবৃত্তি, ক্রীড়া নৈপুণ্য, সেশন পারফর্ম, গ্রুপ ওয়ার্কিং ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতার বিচারে পায় ইন্টারন্যাশনাল রোটারি ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড। একই বছর জিটিভির আমন্ত্রণে অংশ নেয় ‘আজকের অনন্যা’ অনুষ্ঠানে।
বাবা মুহাম্মদ আবদুল হাই অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ও মা মাহমুদা বেগম গৃহিণী। চাঁদনীর বাবা বলেন, ‘ছেলেবেলা থেকেই ও খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারত। বিতর্কে ভালো করার এটাও একটা কারণ। এ ছাড়া যাতে তার আগ্রহ, তা-ই সে করে। কোনো কিছু শুরু করে শেষ না করে ছাড়ে না। ‘
চাঁদনীর মা বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই আমি মেয়ের পারফরমেন্স দেখতে যাই। ও যখন স্টেজে উঠে, আমি উদ্বিগ্ন থাকি। সে ঠিক পারবে কি না! ও যখন পুরস্কার পায় কী যে আনন্দ আমার!’
চাঁদনীর ছোট বোন ঊষাও বিতর্কপ্রেমী। দুই বোন একসঙ্গে চালিয়ে যায় বিতর্কচর্চা। বন্ধুরা সব সময়ই চাঁদনীকে উৎসাহ দেয়। চাঁদনী জানায়, প্রিয় বন্ধুদের তালিকায় আছে হৃদি, বর্ষা, কাউসার, সুলতানা, বাপ্পীসহ অনেকেই।
সহযোগিতা করেন কলেজের শিক্ষকরাও। অনেক শিক্ষকই পরামর্শ, উৎসাহ, বইপুস্তক দিয়ে সাহায্য করেন। বিশেষ করে শাহরিয়ার স্যার অনেক সহযোগিতা করেন। একদিনের ঘটনা মনে পড়লে হাসি পায়, আনন্দও লাগে চাঁদনীর, ‘সবেমাত্র চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছি। একদিন খালেদ স্যার ক্লাসে এসে আমাকে দাঁড় করালেন। ভয়ই পেলাম, না জানি কী অপরাধ করেছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার সেদিন সবার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমার অনেক প্রশংসা করলেন। বললেন, ও অনেক ভালো বিতর্ক করে।’
অবসরে রবীন্দ্রসংগীত গায় চাঁদনী। ভালো লাগে ঘুরে বেড়াতে। বইপড়া প্রতিদিনের রুটিন। বেশি পড়া হয় হুমায়ূন আহমেদের বই।
লেখালেখিও চলে সমানতালে। তাঁর বেশ কিছু লেখা স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখি সম্পর্কে চাঁদনী বলে, ‘একদিন মনে হলো, অনেক কবিতা তো আবৃত্তি করি; কিন্তু লিখছি না কেন। নিয়মিত গল্প, প্রবন্ধ পড়ি অথচ লিখি না! এমন চিন্তা থেকেই লিখতে শুরু করলাম। সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম প্রথম। সেটা স্থানীয় একটা পত্রিকায় দিলাম। এক মাস পর ছাপা হলো। সে থেকেই লিখছি। সময় পেলে কিছু না কিছু লিখতে চেষ্টা করি।’
পড়ালেখায়ও ভালো চাঁদনী। পড়ালেখার শুরু চাঁদপুরের আল-আমিন একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজে। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পায়। এসএসসিতে পেয়েছে জিপিএ ৫। চাঁদপুর সরকারি কলেজের এ ছাত্রী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে চাঁদনী বলে, ‘সবার আগে ভালো মানুষ হতে চাই। দেশের জন্য কাজ করতে চাই। স্বপ্ন দেখি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের।’