ঢাকা: ‘আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুক্তিকামী জনতার সেতুবন্ধন’ এ বিষয়টিকে প্রতিপাদ্য করে বিশ্বের ৯০টি দেশের প্রায় ৪০ কোটিরও বেশি আদিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশের ৪৫টি জাতিসত্তার প্রায় ৩০ লাখ ‘আদিবাসী’ও পালন করছে বিশ্ব আদিবাসী দিবস। ১৯৯৩ সালকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা করেছিল। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘আদিবাসী’ দিবস উদযাপন করেনি। এ বছর সরকার দিবসটি পালনে কোনো নিষেধাজ্ঞাও প্রদান করেনি। তাই সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও এ দিবসকে ঘিরে চলছে নানা আয়োজন।
৯ আগস্ট সারাবিশ্বে যখন পালিত হচ্ছে আদিবাসী দিবস তখন বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’দের অবস্থান তুলে ধরতে এই আগস্ট মাসেরই দু’টি চিত্র তুলে ধারা হলো বাংলামেইলের পাঠকদের সামনে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার জিনারপুর ইউনিয়ন। এলাকায় আদিবাসীদের ভূমি অধিকার, নারীর উপর সহিংসতা বন্ধের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন আদিবাসী নেত্রী বিচিত্রা তির্কী (৩০)। দারিদ্র্যের কারণে ২০০৩ সালে বিনাচিকিৎসায় অকালে তার স্বামীর মৃত্যু হয়। কিন্তু স্বামীর মৃত্যু তাকে অসহায় করলেও দিয়েছে জীবন সংগ্রামের শক্তি। তাই দীর্ঘ লড়াই শেষে মৃত স্বামীর প্রায় দশ একর বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করে নজির সৃষ্টি করেছেন এক সময়ের দরিদ্র অসহায় এ নারী।
শুধু তাই নয়, ওই এলাকার দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ জমিতে তার নেতৃত্বে একদল আদিবাসী নারী শ্রমিক চাষাবাদ করে আসছে। এখন তিনি গোমস্তাপুর উপজেলার পার্বতীপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী সদস্য। তার এই নেতৃত্বে বেশ স্বস্তিতে দিন কাটছিল আদিবাসীদের। কারণ বিপদে, অধিকার আদায়ে, আনন্দ-উৎসবে সব সময় তারা পাশে পায় বিচিত্রাকে। অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামের কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়িয়ে বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলের আদিবাসীদের কাছে এখন জনপ্রিয় এই নারী।
কিন্তু ধর্ষিত হওয়ার সময় কেউ ছিল না তার পাশে। কারণ সন্ত্রাসী হামলার মুখে নিজের শ্রমিক ও স্বজনদের চলে যেতে বলেন তিনি নিজেই। নিজের ক্ষতি করেও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন অন্যদের।
৪ আগস্ট সোমবার। সূর্য তখন মাথার উপর। সময় দুপুর ১২টা। ধানের জমিতে কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে কাজ করছিলেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটির ওই নেত্রী। তাপদাহে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষ করছেন জমি। এমন সময় জিনারপুর গ্রামের জালিয়াত চক্রের আফজাল হোসেন, মনিরুল ইসলাম, আব্দুল হামিদ, আবুল কালাম, আব্দুস সালাম, তরিকুল ইসলাম ও শেরপুর গ্রামের আক্তারসহ ৩০ থেকে ৩৫ জনের একটি দল হাসুয়া, লাঠি, কোদালসহ দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের উপর হামলা চালায়।
এ সময় ভূমিদস্যুরা কোদালের বাট দিয়ে ইউপি নারী সদস্যকে বেদম মারধর করে। হামলাকারীদের মারধরে আহত হয়ে দু’জন পুরুষসহ নারী ক্ষেতমজুররা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। হামলাকারীরা একদিকে চাষের মহিষ, পাওয়ার টিলার লুট করে নিয়ে যায় আর অন্য দিকে মনিরুল ইসলাম (৪৮), আবুল কালাম (৪৫) ও আক্তার (৪০) আদীবাসী ওই নেত্রীকে টেনেহেঁচড়ে ফাঁকা মাঠের আলে নিয়ে ধর্ষণ করে। সে কী বর্বরতা! যেন মধ্যযুগে ফিরে গেছে জিনারপুর গ্রাম।
পরে আহতাবস্থায় স্থানীয়রা তাকে রহনপুরস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য সেখান থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
ওই রাতেই উপজেলার জিনারপুর গ্রামের বাসিন্দা ওই নারী বাদী হয়ে ১৮ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত পরিচয়ের আরো ১৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি জিয়াউল করিমকে রাতেই জিনারপুর গ্রামে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে আজিজুর রহমান (৫০) ও আনিসুর রহমানকে (৪৮) গ্রেপ্তার করলেও হামলার মূলহোতা আফজাল হোসেন, মনিরুল ইসলাম এবং অভিযুক্ত ধর্ষণকারীদের সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে সারাদেশের আদিবাসী।
দু’দিন পিছিয়ে এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা যাক দিনাজপুরের নবাগঞ্জ উপজেলার কুশদহ ইউনিয়নের ডেড়কামারি গ্রাম থেকে। ২ আগস্ট। সকাল ৯টার দিকে ঢুডু সরেন হিলিরডাংগা বাজারে তার বাইসাইকেল মেরামত করিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে খালিপপুর গ্রামে পৌঁছলে ওই গ্রামের গোফফার ও তার ভাই আজাহার আলী তার গতিরোধ করে। ঢুডু সরেনকে মারতে মারতে গোফফারের বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়িতে নেয়ার পর তারা দু’জনসহ আরো ৬ থেকে ৭ জন ধারালো অস্ত্র ও লাঠি দিয়ে ঢুডুকে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে। এমন দৃশ্য দেখে কয়েকজন গ্রামবাসী ঢুডুকে রক্ষা করতে গেলে হামলাকারীরা তাদেরও ধাওয়া করে। একপর্যায়ে বাজার থেকে আরো লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছলে গোফফার ও তার লোকজন সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
ঢুডুর ছেলে ও গ্রামবাসী তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ঢুডু সরেন।
ঢুডুর স্ত্রী ফুলমনি ও ছেলে রবি সরেন এর নেপথ্যের কারন তুলে ধরে বলেন, খালিপপুর গ্রামের মৃত গোলজার হোসেনের ছেলে আব্দুল গোফফার ও তার ভাইয়েরা জাল দলিল করে তাদের জমি দখলের চেষ্টা করছিল। এতে বাধা দেয়ায় প্রায়ই তারা ঢুডু সরেনকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিল। এমনকি এর আগে ১৯৭৩ সালে ঢুডু সরেনের বাবা ফাগু সরেনকও ওই একই পরিবারের ভূমিগ্রাসীরা হত্যা করে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঢুডু হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে এখনো দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশের আদিবাসী সংগঠন সান্তাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (সাসু), বাংলাদেশ ওঁরাও ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠন, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, যুব পরিষদ ও জন উদ্যোগ।
এ হত্যাকাণ্ডের মাত্র তিনদিন আগে অর্থাৎ ২৭ জুলাই শেরপুর জেলার জিনাইগাতী উপজেলার ডেফলাই গ্রামে ভাইয়ের স্ত্রীকে ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করতে গেলে ধর্ষণকারীরা সুবল হাজংকে (৬০) হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডেও পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।
এমন অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসী সংগঠনের নেতারা বলেন, সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যু, হত্যাকারী, নারী ও শিশু ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়ায় আদিবাসীদের ওপর তাণ্ডবলীলা সীমাহীনভাবে বেড়েই চলেছে। তাই শিগগির সরকারকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে স্বাধীন দেশে সমমর্যাদার নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকাটা আদিবাসীদের স্বপ্নই থেকে যাবে।