তারকাদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো প্রায় সব সময়ই অমীমাংসিত থেকে যায়। সালমান শাহের মৃত্যু হত্যাকাণ্ড নাকি আত্মহত্যা এ নিয়ে বড় একটি প্রশ্নবোধক রয়ে গেছে এখনো। সেই তালিকায় রয়েছেন মিতা নূর, রাহারাও। এত আলো ঝলমলে দুনিয়ার বাসিন্দাদের কী এত অভিমান, কেনই বা আশপাশের মানুষের ক্রোধের শিকারে পরিণত হন তারা। লিখেছেন
তামিম হাসান
আত্মহত্যা। এর পেছনে হাজার যুক্তি দাঁড় করলেও ইতিবাচক কোনো দিক খুঁজে পাওয়ার অবকাশ নেই। হতাশা-ব্যর্থতা, দুঃখ-অভিমানের বিপরীতে বেঁচে থাকার নামই জীবন। এ জীবন সুন্দর। এ জীবন আনন্দময়। কিন্তু তারপরও হতাশাগ্রস্ত মন কখনো কখনো বেছে নেয় পৃথবী থেকে চলে যাওয়ার এ ঘৃণ্যতম পথ।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রকে নিয়ে যখন দর্শক নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মাধ্যমে শোবিজে পা রাখা সালমান শাহ যখন একের পর এক দর্শকপ্রিয় ছবি উপহার দিচ্ছিলেন, তখনই তার পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার খবরে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ থমকে গিয়েছিল তার ভক্তরা। কেউ বিশ্বাসই করতে চায়নি সালমান শাহ আর কোনো দিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন না। যার কথা, পোশাক, চলন, অভিনয় ক্রমেই তরুণ প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠছিল অনুকরণীয়, তার কেন ‘আত্মহত্যার’ মধ্য দিয়ে সবার কাছে থেকে বিদায় নিতে হবে? সে প্রশ্নের উত্তর এখনো তারা করে ভক্তদের। তবে তার পরিবার ও ভক্তকুলের কেউই বিশ্বাস করতে চায় না সে ‘আত্মহত্যা’ করেছে। কিন্তু পরে তদন্ত রিপোর্টে প্রকাশ পায়, আত্মহত্যাই করেছিলেন সালমান। চিত্রপরিচালক সোহানুর রহমান সোহান এই যুক্তিকে সমর্থন দিয়ে বলেছেন, ‘সালমানের কোনো শত্রু ছিল না, সে আত্মহত্যা করেছে বলেই মনে হয়। ১৯৯৬ সালে ৬ সেপ্টেম্বর সকালে ‘তুমি শুধু তুমি’ ছবির শুটিংয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সালমান ঘুমাতে থাকেন। বেলা ১১টার দিকে সালমান ঘুম থেকে উঠে দুই কাজের মেয়ের একজনকে ডেকে চা ও পানি খান। কিছুণ পর ড্রেসিংরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। ঢোকার আগে দেহরক্ষী আবুলকে বলে যান, আমাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে। সাড়ে ১১টার দিকে আবুল সালমানের স্ত্রী সামিরাকে জাগিয়ে বলেন, অনেকণ আগে ড্রেসিংরুমে ঢুকলেও তার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সামিরা দরজার ডুপ্লিকেট চাবি খুঁজতে থাকেন। পৌনে ১২টায় ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে আবুল ও সামিরা ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে দেখেন ফ্যানের সাথে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছেন সালমান। সামিরা ও দুই কাজের মেয়ে সালমানকে উঁচু করে ধরেন। পাশের বাসার কাজের মেয়ে দড়ি কেটে সালমানকে নামিয়ে আনেন। এর পড়ের ঘটনা সবারই জানা।
সালমানের এভাবে চলে যাওয়া নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে কেন তিনি এই পথ বেছে নিলেন? এরপরেও বাংলাদেশের তারকাদের আত্মহত্যা কিংবা তার চেষ্টা থেমে থাকেনি। ২০১৩ সালের ২২ মার্চ রাতে মোহাম্মদপুরের চাঁন মিয়া হাউজিংয়ের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় লাক্স তারকা সুমাইয়া আসগর রাহার লাশ। পুলিশের তথ্য, পারিবারিকভাবে আর্থিক সঙ্কটে থাকা রাহা একপর্যায়ে নানা প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। রহস্যময় সম্পর্কের দুর্ভেদ্য জালে জড়িয়ে ছিলেন রাহা। বিচরণ শুরু করেছিলেন অন্ধকার জগতে। বাসায় ফিরতেন মধ্যরাতে। কিন্তু রাহার এমন বেপরোয়া চলাফেরা ধরা পড়ে প্রেমিক সাকিবের চোখে। এরপরই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এমন দোলাচলে সাকিবকে নিয়েই সুখী হতে চেয়েছিলেন রাহা। কিন্তু এতে বাদ সাধে সুযোগ-সন্ধানী একটি প্রভাবশালী মহল। একে একে রাহার কাছ থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেন। মিডিয়ায় কাজ করার পথগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যায় তার। বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ, জীবনের শেষের দিনগুলোতে রাহার চলাচল ছিল হাই প্রোফাইলের লোকজনের সাথে। কিন্তু প্রেমিক তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনে বাধা দেয়ার কারণে সম্পর্কের অবনতি ঘটে তাদের। হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন রাহা।
রাহার মৃত্যুর মাত্র পাঁচ দিন পর ২০১৩ সালের ২৭ মার্চ গভীর রাতে আত্মহত্যা করেন মডেল ও অভিনেতা অলি। ঢাকার মালিবাগের নিজ বাসায় স্ত্রী ও অন্যদের সাথে ঝগড়া করে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে জানা যায়। পরিবারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেশ কয়েক মাস অলির সাথে ঝগড়া চলছিল। এতে তিনি মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। মানসিক বিপর্যয় তিনি আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আর এ জন্যই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। আত্মহত্যার সময় তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ছিল। সিগারেটের আগুন থেকে তার পরনের কাপড়ে আগুন লেগে যায়। কাপড় পোড়া গন্ধ পেয়েই অলির বাবা-মা রুমে গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান।
অলির আত্মহত্যার কয়েক মাস পরে ২০১৩ সালের ১ জুলাই গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী মিতা নূর। এই অভিনেত্রীর বাবা ফজলুর রহমানের দাবি, স্বামী শাহনূর রহমান রানার অত্যাচার নির্যাতনেই তার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, স্বামী শাহনূরের সাথে মিতার প্রায়ই ঝগড়া হতো। এর আগে তাকে দুইবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। পুলিশ বলেছিল, গুলশান-২ এ অবস্থিত ১০৪ নম্বর রোডের ১৬ নম্বর হোল্ডিংয়ের প্রাসাদ লেকভ্যালি অ্যাপার্টমেন্টের ছয়তলার বাসা থেকে মিতা নূরের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় তার গলায় ওড়না পেঁচানো ছিল। অলিম্পিক ব্যাটারির ‘আলো আলো বেশি আলো’ বিজ্ঞাপন করে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছিলেন মিতা নূর।
মূলত এসব তারকা ব্যক্তিজীবনের নানা টানাপড়েন, উচ্চাভিলাষের বিপরীতে জীবনের বাস্তবতার হিসাব না মেলাতে পেরেই হয়ে পড়েন হাতাশাগ্রস্ত। এ হতাশাই হয়তো তাদের ঠেলে দেয় এ নির্মম পরিণতির দিকে।
তবে ভক্তদের হৃদয়ে মিতা নূর সালমানরা চিরদিনই বেঁচে থাকেন বড় একটি প্রশ্নবোধক হয়ে। তাদের এই মৃত্যু হত্যাকাণ্ড না আত্মহত্যা এ প্রশ্নটির উত্তর মেলে না কোনোদিন।