ঢাকা: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হলে ৯৬ অনুচ্ছেদটি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাবে। তবে অনুচ্ছেদটির বর্তমান রূপ বাহাত্তরে ফিরে গেলেও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ এর পরিবর্তে দফা ২, ৩ ও ৪ প্রতিস্থাপিত হবে।
সংসদে উত্থাপিত বিলের ও বর্তমান ৯৬ অনুচ্ছেদের ১ দফায় বর্ণিত ‘অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে কোনো বিচারক সাতষট্টি বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন’ অপরিবর্তিত রয়েছে।
সংসদে উত্থাপিত বিলের দফা (৩) এর শব্দগত পরিবর্তন এনেছে স্থায়ী কমিটি। এই দফায় উল্লেখিত এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের আসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিবেন। এই দফায় সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ ‘করিবেন’ শব্দের পরিবর্তে ‘করিতে পারিবেন’ শব্দ দু’টি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যা ছিল
১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘বিচারকদের পদের মেয়াদ’ শীর্ষক ৯৬ অনুচ্ছেদে ২ দফায় বলা হয়- প্রমাণিত ও অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।
৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বলা ছিল- এই অনুচ্ছেদের ২ দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবে।
আর ৯৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফায় বলা হয়- কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।
বর্তমান সংবিধানের যা রয়েছে
বিচারকের পদের মেয়াদ সম্পর্কে ৯৬ অনুচ্ছেদের ১ দফায় বলা হয়- এই অনুচ্ছেদের অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে, কোনো বিচারক ৬৭ বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন।
৯৬ অনুচ্ছেদের ২ দফায় বলা হয়- এই অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ বিধানাবলী অনুযায়ী ব্যতীত কোনো বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে না।
এবং ৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বলা হয়- একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলিয়া উল্লিখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে:
তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোনো সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এইরূপ কোনো বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন কারণে কার্য করিতে অসমর্থ হন তাহা হইলে কাউন্সিলের যাহারা সদস্য আছেন তাহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসাবে কার্য করিবেন।
৯৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফায় বলা হয়- (ক) বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচরণ বিধি নির্ধারণ করা এবং (খ) কোনো বিচারকের অথবা কোনো বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপ পদ্ধতি ব্যতীত তাহার পদ হইতে অপসারণ যোগ্য নহেন এইরূপ অন্য কোনো কর্মকর্তার সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা নিয়ে কাউন্সিলের দায়িত্ব বিষয়ে বলা হয়েছে।
৯৬ অনুচ্ছেদের ৫ দফায় বলা হয়- যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোন বিচারক- (ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা (খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেইক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্তফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।
৯৬ অনুচ্ছেদের ৬ দফায় বলা হয়- কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির নিকট যদি এইরূপ রিপোর্ট করেন যে, উহার মতে উক্ত বিচারক তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করিবেন।
৯৬ অনুচ্ছেদের ৭ দফায় বলা হয়- এই অনুচ্ছেদের অধীনে তদন্তের উদ্দেশ্যে কাউন্সিল স্বীয় কার্য-পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করিবেন এবং পরওয়ানা জারী ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টের ন্যায় উহার একই ক্ষমতা থাকিবে।
৯৬ অনুচ্ছেদের ৮ দফায় বলা হয়- কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।
বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের কাছে হস্তান্তরের বিলটি গত ৭ সেপ্টেম্বর সংসদে উত্থাপন করা হয়। বিলটি পাস হলেই সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানে স্থান করে নেবে। একই সঙ্গে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদটি ফিরে যাবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে।
তবে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশোধনী এটিই প্রথম নয়। এর আগেও বিচারপতিদের অভিসংশন ও এ বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কার্যক্ষমতা নিয়ে গঠিত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনী হয়েছে।
সংবিধানের শুরুতে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় উচ্চ আদালতের বিচারকদের পদের মেয়াদ নির্ধারণ ও তাদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল।
এরপর ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পরে ১৯৭৮ সালে চতুর্থ সংশোধন বাতিল হলে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের আমলে এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়।
তবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর বিচারকদের অভিশংসনের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধান থেকে বিলীন হয়ে যাবে। আর এ কাউন্সিলের পরিবর্তে বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা বাহাত্তরের সংবিধান অনুসারে সংসদ সদস্যদের হাতে ফিরে যাবে।