প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি নয়, ষড়যন্ত্র হয়েছে দাবি করে বলেছেন, পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বাধা দিতেই এ সেতু প্রকল্পের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল। আমরা তখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। দুর্নীতি প্রমাণিত হয়নি। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে নদীশাসন ও সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে অবহেলিত এ অঞ্চলে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। মানুষের জীনবযাত্রার মানে উন্নয়ন ঘটবে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধের খোলা মঞ্চে নিজ নির্বাচনী এলাকা টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলায় বিদ্যুৎ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের বাস্তবায়িত সাতটি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আব্দুল হালিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, শিশু ও মহিলাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব:) ফারুক খান এমপি, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী এমদাদুল হক, কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র জয়ধর, সাধারণ সম্পাদক এস এম হুমায়ূন কবীর, টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার খায়েরসহ আরো অনেকে বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করে বলেন, কিছু লোক আছে, ভালো কাজ করলেও তাদের ভালো লাগে না। তারা বলে এ সরকার কিছুই করে নাই। তাদের কোনো জনপ্রিয়তা নেই। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতাও তাদের নেই। জনগণ তাদের ভোট দেয় না। অবৈধ পথে কেউ ক্ষমতা দখল করলেই তাদের কদর বেড়ে যায়। তারা পরাজিত শক্তি। জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা ও পদলেহনকারী। এদের কথায় আপনারা কান দেবেন না। আওয়ামী লীগ বেসরকারি টেলিভিশন দিয়েছে। দেশের মানুষের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সেই বিদ্যুৎ দিয়ে এসি রুমে বসেই ওই পরাজিত শক্তি সরকার কিছুই করেনি বলে বক্তব্য দিচ্ছে। টেলিভিশন তা প্রচার করছে। পরাজিত শক্তির এসব মিথ্যা অপপ্রচার দেখলে মনে হয় সব কিছু বন্ধ করে দেই।
তিনি বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা করে বলেন, বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় এসে জঙ্গিবাদের উন্নয়ন করেছে। দুর্নীতি, খুন, সন্ত্রাস করে লুটপাট করেছে। দেশের খাদ্য উৎপাদন, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, চিকিৎসাসহ সব সেক্টর ধ্বংস করেছে। দেশে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে। সে সময় মানুষের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। ৫ জুনের নির্বাচন বানচালের জন্য তারা সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য করেছে। কিন্তু সফল হতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দারিদ্র্যের হার ২৫ ভাগে নেমে এসেছে। দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনে আমরা দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করব। আমরা ৩ কোটি ৬৮ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করেছি। মাছ, তরিতরকারি, ফল, ডিম, দুধ, মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি করছি। কৃষককে ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছি। তাদের পর্যাপ্ত সার, বীজ ও কৃষি উপকরণের ব্যবস্থা করেছি। কৃষকের ভর্তুকির টাকা আমরা অ্যাকাউন্টে দিয়ে দিচ্ছি। কেউ মেরে খেতে পারছে না। আমরা শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল সরকারি করেছি। বছরের প্রথম দিনেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৩১ কোটি ৭ লাখ বই বিতরণ করেছি। এক কোটি ২০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দিচ্ছি। উচ্চাশিক্ষা বৃদ্ধিতে প্রধানমন্ত্রীর ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ডিগ্রি পর্যায়ের এক লাখ ৩৩ হাজার ছাত্রীকে বৃত্তি দিচ্ছি। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও আধুনিক শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সারা দেশে ২৪ হাজার মাল্টিমিডিয়া কাসরুম স্থাপন প্রকল্পের মধ্যে ২২ হাজার মাল্টি মিডিয়া কাসরুম স্থাপন করেছি। প্রত্যেক ইউনিয়নে আমরা তথ্য সেবাকেন্দ্র করে দিয়েছি। এখান থেকে মানুষ সেবা পাচ্ছে। এখানে কর্মরতদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এক কোটি মানুষকে আমরা চাকরি দিয়েছি। ২৪ লাখ মানুষকে ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করে বিদেশে পাঠিয়েছি। কমিউনিটি কিনিক করে দিয়েছি। এখান থেকে মা ও শিশু চিকিৎসা পাচ্ছে। আমরা গৃহহীন এক লাখ পরিবারকে ঘর করে দিয়েছি। উত্তরাঞ্চলে এখন আর মঙ্গা নেই। গরিব মানুষকে আমরা বিনামূল্যে খাদ্যসহায়তা দিচ্ছি। খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রে আমরা উন্নয়ন সাধন করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য পায়রা সমুদ্রবন্দর, রামপাল ও পটুয়াখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছি। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট করে দিচ্ছি। নদী ড্রেজিং করে নৌযোগাযোগ ত্বরান্বিত করছি। নৌপথে সহজে কম খরচে পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করছি। এখানে এসব করা হলে শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠবে। দক্ষিণাঞ্চল আর অবহেলিত থাকবে না।
তিনি আরো বলেন, শহরের মানুষ শুধু ফ্যাটে বসবাস করে। আমরা গ্রামের মানুষের জন্য পল্লী জনপদ নামে নতুন ফ্যাট প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। এখানে প্রথম তলায় থাকবে ডেইরি ফার্ম, দ্বিতীয় তলায় থাকবে পোলট্রি ফার্ম, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় মানুষ বসবাস করবে। ছাদে তাদের উৎপাদিত পণ্য শুকানোর ব্যবস্থা থাকবে। গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে আমরা প্রথম পাইলট প্রকল্প শুরু করব। পরে সারা দেশের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে তা ছড়িয়ে দেবো।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোনো ঘর অন্ধকার থাকবে না। আমরা প্রতিটি ঘর আলোকিত করব। যেখানে বিদ্যুতের গ্রিড লাইন নেই, সেখানে আমরা সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপন করে দেবো। আমরা এ পর্যন্ত ৩৩ লাখ পরিবারে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। মন্দার মধ্যেও আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ। রিজার্ভ ২২ লাখ মার্কিন ডলার। সব দিক দিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
নিজ নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমি জাতিসঙ্ঘের উদ্দেশে ২১ সেপ্টেম্বর রওনা দেবো। পিতার কবর জিয়ারত ও আপনাদের দোয়া-আশীর্বাদ, মিলাদে অংশ নিতেই টুঙ্গিপাড়া এসেছি। আপনারা আমাকে দোয়া করবেন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর টুঙ্গিপাড়া-কোটালীপাড়া তথা বাংলাদেশের মানুষ আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছে। আমি আপনাদের এলাকা থেকে নির্বাচন করি। আমার পক্ষ হয়ে ভোট চাওয়ারও কেউ নেই। তারপরও বিপুল ভোটে আপনারা আমাকে নির্বাচিত করেন। এ জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এ দেশের মানুষ আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছে। তাদের জন্য আমি আজীবন ত্যাগ স্বীকার করে যাবো।
শুক্রবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে ঢাকা থেকে হেলিকাপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়া এসে পৌঁছেন প্রধানমন্ত্রী। সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে তিনি বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে তিনি ফাতেহা পাঠ ও বিশেষ মুনাজাতে অংশ নেন। এ সময় নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. খায়রুল আলম খান, রেজিস্ট্রার মো: জাকির হোসেন, লে. কর্নেল (অব:) ফারুক খান এমপি, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, শেখ হেলাল উদ্দিন এমপি, তার মেয়ে শেখ অনন্যা প্রধানমন্ত্রীর তথ্যসচিব শামীম চৌধুরী, সাইফুজ্জামান শেখর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের খোলা মঞ্চে তার নির্বাচনী এলাকা কোটালীপাড়া ও টুঙ্গিপাড়ার ১২ হাজার পরিবারের বিদ্যুৎ সংযোগ, টুঙ্গিপাড়া ৫ এমভিএ বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, টুঙ্গিপাড়া উপজেলা পরিষদ ভবনে ৩০ কিলোওয়াট সোলার প্যানেল, কোটালীপাড়া উপজেলার রাজাপুর খেয়াঘাট-জহুরেরকান্দি সড়কে ৩৯ মিটার গার্ডার ব্রিজ, পূর্ব লাটেঙ্গা-ভাঙ্গারহাট সড়কে ১৭ মিটার আরসিসি গার্ডার ব্রিজ, বান্ধাবাড়ী ইউনিয়নের ভাই ভাই সড়কে ৩০.০৫ মিটার আরসিসি গার্ডার ব্রিজ এবং টুঙ্গিপাড়া উপজেলা সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব ভবন উদ্বোধন করেন।