দিবাস্বপ্ন এবং দুঃসহ দহন

0

Sontosসন্তোষ মন্ডল
দিবাস্বপ্ন মানেই হচ্ছে কল্পনা প্রসূত স্বপ্ন, যে স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়ন হয়না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এমন একটা দিবাস্বপ্ন দেখছেন শত শত মানুষ, আর উপরের দিকে হাত তুলে কামনা করছেন, এই স্বপ্ন যেন কখনোই বাস্তবায়ন না হয়। প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না, চোখের সামনে যা দেখছি তা কি সত্যি? আমি কি সত্যি সত্যিই রাস্তায় দাঁড়িয়ে, না ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি?

না না, সত্যিইতো আমি রাস্তায় হাঁটছি! এটাতো প্রেসক্লাব, তোপখানা রোড! রাস্তার ওপাশে সচিবালয়! এসবই তো আমার অতি চেনা! তাহলে এই পড়ন্ত বেলায় সামনে যা দেখছি তা কি সত্যি? এমনটা কি হতে পারে! একটা বাস রাস্তা দিয়ে চলছে, তার পুরো শরীর জুড়ে আগুন জ্বলছে। আগুন আর কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া উঠছে উপরের দিকে। বাসটি চলছে সামনের দিকে। গায়ে আগুন নিয়ে ধীরে ধীরে চলা বাসটিতে কোনো চালক নেই। চালক থাকবে কিভাবে? চালকতো আগেই ভেগেছেন। আর না ভেগেই বা উপায় কি! কে চান এই চলন্ত আগুনে পুড়ে মরতে!

কিন্তু যে লোকগুলো এখনো নামতে পারেননি তাদের কি হবে? ছোট্ট একটি শিশু নিয়ে যে মহিলা বাসটির দরজা দিয়ে নেমে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তার কি হবে? তিনি কি পারবেন নিরাপদে নেমে আসতে? হাতে একদম সময় নেই, পেছনে ধেঁয়ে আসছে আগুনের লেলিহান শিখা। এমন একটা রূদ্ধশ্বাস অবস্থায় আশপাশের দু’একজনের সহযোগিতায় মহিলা অবশেষে নেমে এলেন বটে, কিন্তু বাসটি চলছে তো চলছেই। আশপাশে শত শত মানুষ অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে। কারো কিছুই করার নেই। কিভাবে থামবে বাসটি? ব্রেক না হলে থামবে কিভাবে! এমন অনেক হা-হুতাশ, আহাজারি আর করুন আর্তনাদ ভেসে আসছে চারদিক থেকে। কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। কি করলে বাসটি থামানো যায়-তা নিয়ে ভাবনা-গবেষণার সময় কই! এই..এই… এক্ষুনি ধাক্কা খাবে সামনের বৈদ্যুতিক খুঁটিতে। তারপর হয়তো গিয়ে পড়বে পাশের ফুটপাতের দোকান পাটের উপর। এমনও হতে পারে দুই বৈদ্যুতিক খুঁটির মাঝখানের ট্রান্সফর্মারটি বিস্ফোরণ ঘটে আগুন আরো ব্যপকতা লাভ করতে পারে। তখন কি হবে?

এক অজানা আশঙ্কায় বুকের মধ্যে ধড়ফড় করছে। কয়েকজন লোক আশপাশ থেকে কয়েকটা ইট এনে বাসটির টায়ারের নিচে ছুঁড়ে দিয়ে চেষ্টা করছে করছেন থামানোর। কিছুতেই সম্ভব হচ্ছেনা। একটার পর একটা ইট মাড়িয়ে বাসটি তবুও এগিয়ে চলছে। ঠিক এমনি সঙ্কটময় মূহূর্তে সামনের বাম পাশের চাকাটি ইটের বাঁধা পেয়ে সামান্য একটু ডানে বাঁক নিল। এরপরও দেহ ভর্তি আগুন নিয়ে এগুচ্ছে বাসটি। তবে এভাবে এগুলে আর হয়তো বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা নাও খেতে পারে, কিংবা গিয়ে পড়বেনা পাশের দোকান পাট অথবা রেস্টুরেন্টের উপর।

এগুচ্ছেতো এগুচ্ছেই.. একটু একটু করে এগুচ্ছে। সবাই আশা করছেন, ডানদিক ঝুঁকে এভাবে এগুলে হয়তো এক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে রোড ডিভাইডারের সঙ্গে। তবুও ভাল, তাই যেন হয়। আশপাশের সবার এখন একটাই চাওয়া, এমনটি হলে রক্ষা পাওয়া যাবে বড় এবং ভয়াবহ এক দুর্ঘটনার হাত থেকে। শেষ পর্যন্ত রোড ডিভাইডার পর্যন্ত আর পৌঁঁছুতে পারেনি অগ্নিদগ্ধ বাসটি। তার আগেই দৈবক্রমে মিলে যাওয়া দু’তিনটি বালুভর্তি ব্যাগ এনে কে বা কারা যেন ফেলে দিল দু’চাকার সামনে। অবশেষে থেমে গেল। এবার স্থির অবস্থায় দাউ দাউ করে পুড়ে শেষ হলো বাসটি। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা ধংস স্তুপের উপর পানি ঢেলে ১৫ মিনিটের এক রূদ্ধশ্বাস আতঙ্কের পরিসমাপ্তি ঘটালেন।

ঠিক আগুন লাগার মূহূর্তেই রাস্তার ওপার থেকে এগিয়ে আসছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ। ঘড়িতে বিকেল সাড়ে চারটার কিছু বেশি। এখনো দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। ইচ্ছে ছিল, সচিবালয়ের কাজ শেষে বেরিয়ে তোপখানা রোডের কোনো দামী রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসবেন। সেই উদ্দেশ্যেই রাস্তা পার হতে গিয়ে চোখে পড়ল এমন ভয়াবহ এক দৃশ্য। আর কি খাবার রুচি থাকে? কয়েকজন তরুণ সাংবাদিকের কাছে ক্ষোভের কথা বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ প্রচন্ড খেঁপে গেলেন। তার ক্ষোভের পুরোটায় গিয়ে পড়ল পুলিশের উপর। পুলিশের অপরাধ হল-তারা ঘটনাস্থলেই ছিলেন। তোপখানার শিশু কল্যাণ পরিষদের গলির মুখে এমনিতেই পুলিশের একটি দল সার্বক্ষণিক মোতায়েন থাকে। ওই সময়ও ছিল, অথচ এমন একটা ভয়াবহ ঘটনার সময়ে সাধারণ মানুষ এগিয়ে এলেও পুলিশের সদস্যরা তখন ছিলেন নির্বিকার। কি আজব দেশে আমরা বসবাস করছিরে বাবা! তীব্র ক্ষোভ আর হতাশার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আলতাফের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল আরো কিছু অস্রাব্য ভাষা।

কিন্তু বাসে আগুন লাগল কিভাবে? শত শত মানুষের একটাই প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন কে? যে ১০/১৫ জন যাত্রী ওই বাসে ছিলেন তারা যে এখন কে কোথায় আছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আতঙ্ক আর ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছেন সবাই। ফলে প্রত্যক্ষদর্শী খুঁজে পাওয়া গেলনা। তবে, বাসটির পেছনের দিককার সিটে আগুনের সূত্রপাত দেখেছেন আশপাশের লোকজন। এজন্যে ধারণা করা যায়, যাত্রীবেশি দূবৃত্তরা বাসের ভেতরে থেকেই আগুন লাগিয়েছে-এমন ভাসা ভাসা ধারণা দিলেন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার শিবলী নোমান। রমনা জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার তিনি। বললেন, ঢাকা পরিবহনের বাসটির গন্তব্য ছিল গুলিস্তান হয়ে মতিঝিল। প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে অর্থাৎ বিএমএ ভবনের সামনে পৌঁছেলেই বাসটির পেছনের সিটে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। ওই সময়ে এলাকায় বেশ যানজট ছিল। এজন্যে যাত্রীদের অনেকেই নেমে গিয়েছিলেন। ১০/১৫ জন যাত্রী নিয়ে প্রায় ফাঁকা বাসটি খুব ধীরে ধীরে এগুচ্ছিলো সামনের দিকে। তখনই ঘটে আগুন লাগার ঘটনা।

আগুন আতঙ্কে বাসের ড্রাইভার ভেগেছেন আগেভাগেই। কিন্তু স্টার্ট-এ রয়ে গেছে বাসটি। এমনকি গিয়ারও এ্যাকটিভ। যে কারণে বাসটি থেমে নেই, আস্তে আস্তে চলছে আর আগুনে পুড়ছে। এতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র আতঙ্ক। আতঙ্কের কারণে পুলিশ কদম ফোয়ারা থেকে পুরানো পল্টন মোড় পর্যন্ত রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে অন্য জায়গায়। আগুনে জ্বলতে থাকা বাসটি ধীরে ধীরে এগুতে থাকায় সামনের দিকের যানবাহনগুলো পড়েছে মহা বিপাকে। যানজটের কারণে সেগুলো এগুতে পারছেনা। পুলিশের হুইসেল, লোকজনের দিগি¦দিক ছোটাছুটি, পেছনের যানবাহনগুলোর ব্যাক গিয়ারে ছুটে চলা-সব কিছু মিলিয়ে এক হুলুস্থুল কান্ডকারখানা।

এখন প্রশ্ন একটাই, এই আগুন লাগালো কে? কারা ঘটালো এমন ঘটনা? এ প্রশ্নের উত্তর কারো কাছ থেকেই পাওয়া যাচ্ছেনা। পুলিশ যা বলছে তা ভাসা ভসা। পুলিশ বলছে,“আজ সকালেই তারেক রহমানের বিরূদ্ধে মানিলন্ডারিং মামলার রায় হয়েছে। এই রায় উপলক্ষে শুধু ঢাকা নয়, দেশজুড়েই ছিল আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সতর্ক পাহারা। রাজধানীতে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে পুলিশ, তার মধ্যেই ঘটছে এমন ঘটনা।”

কিন্তু রায়েতো তারেক রহমান বেকসুর খালাস পেয়েছেন। সুতরাং তার অনুসারীরা আজ এমন ঘটনা ঘটাবে- সেই সূত্রও মেলাতে পারছেন না পুলিশ কর্মকর্তারা। গত ক’দিন ধরে ৬০+৬০+৮৪ ঘন্টার হরতাল চলাকালে রজধানীতে বেশ কিছু যানবাহনে আগুন লাগানোর ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যে নানাবিধ প্রশ্ন উঠেছে। এক রুটের বাস অন্য রুটে গিয়ে পোড়ার ঘটনা নিয়ে টকশো ওয়ালারা আজকাল বেশ সরগরম। এজন্যে নিশ্চিত হতে পুরানো পল্টন ইন্টারসেকশন পুলিশ বক্সের সামনে দায়িত্ব পালনরত ট্রাফিক কর্তার শরনাপন্ন হতে হলো। পুলিশ কর্মকর্তা পুরোপুরি নিশ্চিত করলেন, ঢাকা পরিবহনের বাস এই রুটেই চলাচল করে।

সন্ধ্যা হতে না হতেই খবর এলো, শুধু তোপখানা রোড নয় ফকিরাপুল, বাড্ডা, খিলগাঁও, কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর আরো কয়েকটি এলাকায় বেশ কিছু যানবাহনে আগুন দিয়েছে দূবৃত্তরা।

কারণ, ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হাবিবকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে দুপুরে। তারই জের হচ্ছে নিরীহ-বোবা যানবাহন গুলোতে আগুন।

লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More