বিরোধী জোটের আন্দোলন মোকবিলায় সরকারের ছক তছনছ হয়ে গেছে। আন্দোলন মোকাবিলার হাতিয়ারগুলো একে একে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব ইজতেমা, পাবলিক পরীক্ষা, পাইকারিহারে গ্রেফতার, নির্যাতন, খালেদা জিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে, মামলা দিয়ে গ্রেফতারের হুমকি, গণমাধ্যমকে কব্জা করে বিরোধী দলের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে মাঠে নামানোর মত সরকারে হাতে থাকা ‘তুরুপের তাসগুলো’ একে একে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে।
এখন অবশিষ্ট আছে ‘ক্রসফায়ার’, ‘জঙ্গি’ ও ‘নাশকতা’ কার্ড। এগুলোও অতিব্যবহারে কার্যকারিতা হারাতে চলেছে। ফলে বার বার পরিস্থিতি স্বাভাবিকের ডেডলাইন ঘোষণা করেও কোন কুলকিনারা হচ্ছে না। প্রকাশ্যে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে অনমনীয় মনোভাব দেখানো হলেও নিজেদের মধ্যে আলোচনায় হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে।
গত ৩ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত ভাগাভাগির সরকার ও সংসদের এক বছরের মাথায় বিরোধী দল নতুন করে আন্দোলনে যাবে এটা সরকারের জানা ছিল আগেভাগেই। সে অনুযায়ী আন্দোলন মোকাবিলায় নানা ছক কষে রাখা হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল জানুয়ারিতে তাবলীগ জামায়াতের দু’দফার বিশ্ব ইজতেমা, ফেব্রয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা, তার পর এইচএসসি পরীক্ষার মত জনসম্পৃক্ত ইভেন্টগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আন্দোলনের আগুনে পানি ঢালার প্রস্তুতি। ধর্মীয় ও পাবলিক সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে আন্দোলনের ভর মওসুম পার করার পর বর্ষা ও রমজান দিয়ে এবছরটি পার পাওয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা ধারণাও করতে পারেননি বিরোধী জোট বিশ্ব ইজতেমা ও এসএসসি পরীক্ষা আমলে না নিয়ে এভাবে লাগাতার অবরোধ ও থেমে থেমে সিরিজ হরতাল কর্মসূচী চালিয়ে যাবে।
সরকার যে ক্যালেন্ডার হাতে নিয়ে বিরোধী জোটের আন্দোলন মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল তা এলোমেলো হয়ে গেছে। ‘বিশ্ব ইজতেমা’ কার্ডও খুব একটা ফল দেয়নি। পাবলিক পরীক্ষার কার্ডটিও খুব একটা কাজে দিচ্ছে না। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা, সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনকে মাঠে নামিয়ে, খালেদা জিয়ার বাসার সামনে কর্মসূচী দিয়ে মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টির কৌশলও কাজে আসছে না। ফলে এখন পুলিশ-র্যাব-বিজিবি দিয়ে খুন, গুম, অপহরণের মাধ্যমে ভীতি ছড়িয়ে আন্দোলনরতদের পরাস্ত করার কৌশল নেয়া হয়েছে। সরকারের ধারণা সংগঠক পর্যায়ে শ’খানেক বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীকে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করলে মনোবল ভেঙ্গে দেয়া যাবে। তাতে চলমান আন্দোলন ভেস্তে যাবে। পরিস্থিতি সহসাই উন্নতি হবে। কিন্তু সরকারের এই কৌশল বুমেরাং হতে যাচ্ছে। ক্রসফায়ারের নামে নিরপরাধ নেতা-কর্মীদের হত্যার ঘটনায় তাদের নিষ্ক্রীয় সহকর্মীরা ক্রমাগতভাবে আন্দোলনে সক্রিয় হচ্ছেন এবং দিন দিন আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে সবদিকে। নির্বিচারে গ্রেফতার, যৌথ অভিযানের নামে বিরোধী নেতাকর্মীদের বাড়ি ঘওে তান্ডব সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুনকে উস্কে দিচ্ছে। আত্মগোপনে থাকা লাখ লাখ বিরোধী কর্মী এখন সরকার পতন ছাড়া ঘরে ফিরতে পারবে না নিশ্চিত হয়ে জীবনপন আন্দোলনে ঝুঁকছে। পরিস্থিতি নাজুক থেকে নাজুকতর হচ্ছে। সরকারের গোয়েন্দারা এরই মধ্যে আভাস দিয়েছেন যে আগামী দিনগুলোতে ক্রসফায়ারের বদলা হিসেবে আন্দোলনকারিদের টার্গেটে পরিণত হতে পারেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সরকারি দলের এমপি, মন্ত্রী ও নেতাকর্মীরা। ইতোমধ্যেই সে ধরণের পাল্টা আক্রমন শুরু হয়েছে। ঢাকার বাইরে চাপাইনবাবগঞ্জে এমপি’র বাড়িতে বোমা হামলা হয়েছে। ঢাকায় দিনদুপুরে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। এ ধরণের আক্রমনের মাত্রা আরও বাড়ার আশংকায় উদ্বেগ বাড়ছে শাসক মহলে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ হরতালে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল জানুয়ারির শেষে। কিন্তু সরকার গাজীপুরে খালেদা জিয়ার জনসভায় বাধা দিয়ে এবং ৫ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের বার্ষিকীর কর্মসূচী মোকাবিলা করতে নিজেরাই ঢাকা অবরোধ করে বিরোধী জোটকে পরিকল্পিত সময়ের আগেই সর্বাত্মক আন্দোলনে ঠেলে দিয়েছে। গত ৪ জানুয়ারি থেকে বিরোধী জোটের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধের পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়াদের হরতালে দেশব্যাপী সিহিংসতা বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে সহিংসতা ঠেকাতে সরকার, তথা প্রশাসনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে সমাবেশ করতে না দেওয়াকে কেন্দ্র করে অস্থিরতার শুরু হয় দেশের রাজনীতিতে। এরও দুই দিন আগে থেকে নিজের বাসা ছেড়ে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। চলতি বছর ৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট রাজধানীসহ সারা দেশে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ শিরোনামে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট একই দিনে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ শিরোনামে পাল্টা কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। একই দিনে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের এমন পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ঘোষণায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) রাজধানীতে সকল প্রকার সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। একই সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপারসনকে কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখে প্রশাসন। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের প্রবেশ পথে ৪ জানুয়ারি থেকে মোট ১৬টি বালু, ইট, খোয়াভর্তি ও পুলিশ বহনকারী ট্রাক, জলকামান এবং এপিসি দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে কার্যালয়ের সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ পাহারার পাশাপাশি প্রধান ফটকে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয় পুলিশ। ৫ জানুয়ারি পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে কার্যালয় থেকে বের হওয়া চেষ্টা করেন বেগম খালেদা জিয়া। এ সময় তার সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়াকে কার্যালয় থেকে বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করে। কর্মসূচিতে অংশ নিতে না পেরে বিএনপি চেয়ারপারসন ওইদিন অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেন। অবরোধ চলাকালে বিভিন্ন মেয়াদে দেশব্যাপী ও বিভিন্ন জেলায় স্থানীয় পর্যায়ে হরতাল কর্মসূচি পালন করে ২০ দলীয় জোট। ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ ও উপর্যুপরি হরতালে ৭ ফেব্রুয়ারি শনিবার পর্যন্ত পেট্রোলবোমায়, দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন মোট ৮৫ জন। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাত্রীবাহী নৈশকোচে পেট্রোলবোমা হামলায় ৮ জন, গাইবান্ধায় ৬ জন এবং বরিশালে ৩জন নিহত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত পেট্রোলবোমার আগুন ও রাজনৈতিক সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ৬৯ জন এবং পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক অন্তত ২০ জন বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন কথিত বন্দুকযুদ্ধে।
এদিকে ২ ফেব্রুয়ারী থেকে সারা দেশে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে তা বার বার পিছিয়ে ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি দুটি বিষয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। ৮ ও ১০ ফেব্রুয়ারির পরীক্ষাও পেছাতে হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় ধারাবাহিক প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা দূর করতে সরকারের সকল পদক্ষেপকে কার্যত ব্যর্থ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা।