মানবতাবাদী লেখক ডেভিট কোরেন-এর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল লন্ডনে। বিশেষ একটি সেমিনারে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে তার কিনৌট ভাষণটি শুনছিলাম মনোযোগ সহকারে। আমার দেশের মতো কারণে অকারণে সেমিনার ডেকে অহেতুক ভাষণ-বক্তৃতার মতো কোনো মুক্ত ব্যবস্থা সভ্য কোনো দেশে নেই। তাছাড়া আমাদের দেশের মতো ভাড়াটিয়া বক্তাও তেমন একটা পাওয়া যায় না।
বঙ্গবন্ধু তখন ক্ষমতায়। তার কিনৌট আলোচনায় আমি আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভূমিকায় এনে বলেছিলাম, মানুষকে তার জন্মগত অধিকার নিয়ে যথাযথভাবে বাঁচতে দেওয়ার নামই যদি মানবাধিকার হয় বা মানুষকে বাঁচানোর মূল দর্শন হয় তাহলে ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে আমাদের ঔপনিবেশিক বন্ধুরা যখন গণহত্যা চালিয়েছিল, নির্যাতন চালিয়েছিল তখন এই মানবতাবাদী বিশ্ব কেন সংঘবদ্ধ হয়ে আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি? কেন তারা দ্বিধাবিভক্তি বা বহুবিভক্তিতে আমাদের প্রাপ্য অধিকারের স্বপক্ষে কথা বলেছিল?
একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সদ্যপাওয়া যুদ্ধের দেশ থেকে যাওয়া সাংবাদিকের তখন কথাবার্তা বেশ শক্তিশালীই ছিল হয়তো বা।
দেখা গেল, আমার আলোচনার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সেই সেমিনারের প্রায় সকলেই আমাদের দেশের যুদ্ধকালীন বর্ণনা সামনে নিয়েই মানুষের অধিকার বিষয়ক কথা বলেছে। চা-বিরতি। বিরতির এক ফাঁকে ডেভিডের সঙ্গে মুখোমুখি হতেই ডেভিড আমার আলোচনাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিল, মূলত তোমাদের বিষয়টি ছিল ক্ষমতাকেন্দ্রিক। যেহেতু মুজিবুর রহমান ও তার দলকে ক্ষমতায় যেতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল ভুট্টো, সেই কারণেই সেই লড়াইটি শুরু হয়েছিল। ঐ যুদ্ধটিকে মুক্তিযুদ্ধ বললেও শুরুতে এটি মুক্তিযুদ্ধ ছিল না। ছিল না স্বাধীনতার জন্য কোনো সংগঠিত বিদ্রোহ। পরবর্তীতে যা হয়েছে সেটি নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে, আগামীতেও হবে এবং এ নিয়ে আমরা অক্টোবর ’৭১-এ লেখালেখি করেছিলাম।
আজকের লেখায় ছোট করে হলেও একটি বাক্য আমার দেওয়া উচিত ছিল। সময় শেষ। উভয়েই চলে গেলাম স্ব স্ব অবস্থানে। চললো বিশ্লেষণ। আমি মূলত সেমিনারে অংশগ্রহণ, কথা বলা এবং যা পাবার তা প্রত্যাশার আঙ্গিকে ডেভিডের কাছ থেকেই পেয়ে গিয়েছিলাম।
বহুদিন পর আমাদের বিজয় দিবসকে চেতনার মসনদে বসিয়ে যখন ভাবছিলাম, তখন এই ডেভিডের কথা মনে হলো। আসলেই যুদ্ধটি শুরু হয়েছিল, পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় আওয়ামী লীগকে বসতে না দেওয়ার কারণে।
যদি সেদিন পাকিস্তানের সামরিক শাসক পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরামর্শ না নিয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে থাকতো তাহলে আজো আমরা পাকিস্তানেই থাকতাম। যেহেতু নেই এবং যেহেতু রাগে-ক্ষোভে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার জাতীয় সনদ লাভ করেছি সেহেতু সবসময় পুরনো সেই কথা লেখায় বা ভাবনায় তেমন একটা ভিড় করে না।
মানুষের দেশ মানুষেই শাসন করবে, শাসনক্ষমতায় মানুষেই বসবে। সেই মানুষরা মানুষের প্রতিনিধি হয়ে মানুষকে নির্যাতন করবে, হত্যা করবে এবং জিম্মি করে রাখবে- এটা কিন্তু গণতন্ত্রের চেতনা নয়; মুক্তিযুদ্ধের বিক্ষুব্ধ চৈত্তিক মানুষের কথাও নয়।
যুদ্ধের সময় ভারত আমাদের সাথে ছিল। আমাদেরকে সহযোগিতা করেছিল সবকিছু দিয়ে। তারপরও যে কথাটি সত্য তাহলো- ভারত তার স্বার্থের অন্ধ মোহ থেকেই আমাদের সঙ্গে সশস্ত্র চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে কখনো কখনো আমাদের চেয়ে বেশি আগ্রহ প্রদর্শন করেছিল ১৯৭১-এ বিভিন্ন রণাঙ্গনে।
বিভিন্ন বাহিনীর বিভিন্ন কৌশল মুক্তিযুদ্ধকে সমৃদ্ধ করেছিল। সেই যুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছিল, কতজন আহত হয়েছিল- এর কোনো সঠিক তথ্য ৪৪ বছরে আমাদের কাছে আসেনি।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হয়। যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিদের নাম নিবন্ধিত করা হয়। পত্র-পত্রিকা ও বইয়ে ছাপানো হয়। একেক বইয়ে একেক রকম। এর মধ্য থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু তদারক করার জন্য একটি মন্ত্রণালয়ও করা হয়েছে। দেশের মুক্তি লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে যখন একজন মুক্তিযোদ্ধা মাসে দু’ হাজার টাকা ভাতা পায় তখন ইচ্ছাই করে ঐ দেশের সরকার বা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়কে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিলে কেমন হয়? এরা মুক্তিযোদ্ধাদের খবর রাখে না; ব্যবসা করে চেতনার। এরা ভুলে যায়, সেই চেতনার সঙ্গে গণতন্ত্র ছিল, ন্যায়বিচার ছিল এবং মুক্তচিন্তা বিকাশের স্ব স্বাধীনতার একটি বিরাট বিষয় সম্পৃক্ত করা হয়েছিল।
৪৪ বছরে আজকে দেশের যে অগ্রগতি আমরা দেখি, তা থেকে মাঝে মাঝে মনে হয়, গাছের চেয়ে আগাছা কিন্তু দ্রুত বাড়ে এবং আগাছাতেও ফুল হয় এবং অপ্রয়োজনীয় ফল ধরে। এই তো সেদিন মালয়েশিয়ার ছাত্ররা আমাদের দেশে পড়তে আসত। আজকে আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের মালয়েশিয়া পড়তে যায়। এরা পিছিয়ে ছিল অনেক বেশি। ভিয়েতনামের মানুষের জন্য আমরা মিছিল করেছি। সেই ভিয়েতনাম এখন আমাদের দেখেই হাসে।
এসব অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে, যাদের কাছে আমরা বিভিন্নভাবে পরাস্ত। আমরা সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছি দর্জিগিরিতে। গত ৩০ বছরে দেশে দর্জির সংখ্যা বেড়েছে। সরকারের সঙ্গে সরকারের এবং সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের রাজনৈতিক সম্পর্ক সন্ত্রাসী নীতিমালায় আটকে গেছে। আজকের এই অবস্থা অনেকটা রাজনীতির বিরুদ্ধে রাজনীতির মতো। বর্তমান প্রেক্ষাপট একদিনে সৃষ্টি হয়েছে, তা কিন্তু নয়। এই ব্যর্থতার জন্য প্রথম যে ব্যক্তিটি দায়ী তিনি জাতির শীর্ষ নেতা। তার পরে যিনি দায়ী তিনিও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা ছিলেন। এই ব্যর্থতার মিছিলে পরে যাদের নাম সম্পৃক্ত হয়েছে জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে আজকের শেখ হাসিনা পর্যন্ত কাউকে এই দায়ের বাইরে বিচার করার সুযোগ নেই।
সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে বছরের পর বছর কারানির্যাতন সহ্য করে জাতির শীর্ষে আন্দোলনি নেতা হিসেবে অবস্থান নেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী সেনারা যখন দেশ শাসনের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে দিলেন জাতির বন্ধু পিতাকে, তিনি মাত্র তিন বছরের মাথায় জনগণের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেলেন। গণতন্ত্রের বিধি-বিধানে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন স্বৈরতন্ত্র। একদলীয় শাসনব্যবস্থার জন্য দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেনি। একদলীয় শাসনব্যবস্থা এবং সামরিক শাসনব্যবস্থা এর মধ্যে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কিংবা মৌলিকত্বে কোনো পার্থক্য আছে- এটা দেশের মানুষ মনে করে না। সেই থেকেই আজকের ঠিকানা আমাদেরকে সুখ-দুঃখের ভেলায় উঠিয়ে দিয়েছে।
দেশ শাসনে যারা নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং যারা নিতে চান, বিজয়ের এই মাসে এবং বিজয়ের দিনে যদি আমরা বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা করে আনন্দকে নিজের মধ্যে অনুভব করানোর চেষ্টা করি তাহলে দেখা যাবে, এদেশের মানুষের মূল চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে একটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন দু’জন নেতা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অতঃপর বীরোত্তম জিয়াউর রহমান।
ক্ষমতায় আরোহণের সূচনায় কিছু মানুষ দিগভ্রান্ত হয়ে বিদেশি দর্শন এবং ভিন্ন ধর্মের সম্পৃক্ততার কারণে বঙ্গবন্ধুকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং যুদ্ধকালীন দেশের মানুষের অবস্থানকে ধর্মীয় বিভাজনে বিভক্ত করার পরামর্শ দিয়ে সফলকাম হয়েছিলেন। খুব নিকট সময়ে বঙ্গবন্ধু এটা বুঝতে পেরেই সেই বিভাজন সংবিধান থেকে তুলে দিয়ে জাতীয় কল্যাণের সঠিক-সরল পথ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
বাকশালের পর জিয়াউর রহমানের উত্থান এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে বহুদলীয় রাজনীতির পথকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। আজকে বহুদিন পর সেই দুটি উদ্যোগ দারুণভাবে ভুলুণ্ঠিত হয়েছে। জাতি মহা বিভক্তিকে উপনীত ২০১৩-এর বিজয় দিবসে।
আমি এবং বাংলাসংবাদ২৪.কম-এর সকল সহকর্মীদের পক্ষ থেকে বিজয় দিবসের বিজয়ের আনন্দ জানাতে চাই এবং বলতে চাই, আমি প্রত্যাশায় আছি কাক্সিক্ষত বিজয়ের। আমি বলতে চাই, বিজয় আমার বিজয়, বিজয় আমাদের বিজয়।