চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপসহ বিভিন্ন কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ সময় বিরোধী ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একঘরে করে রাখা হবে। লক্ষ্য অর্জনে প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয়ভাবে মাঠে নামানো হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের। চলবে হরতাল, অবরোধ ও নাশকতা বিরোধী জনমত গঠনের কাজও। ইতোমধ্যেই বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মকাণ্ডকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে দেশ-বিদেশে উপস্থাপনের চেষ্টা শুরু হয়েছে। বিরোধী জোটকে আরো বিভ্রান্ত করতে শিগগিরই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সঙ্কট নিরসনে সংলাপের প্রস্তাব দেয়া নাগরিকদের নানাভাবে বিতর্কিত করে বক্তব্য দেয়া হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে। তবে সম্প্রতি শুরু হওয়া জোড়ালো কূটনৈতিক তৎপরতার বিষয়টি বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের চলমান হরতাল-অবরোধে দেশজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও হাল ছাড়তে নারাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সুশীলসমাজ, কূটনৈতিকদের উদ্বেগ এবং সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোর চাপেরও শেষ দেখতে চায় দলটি। সে জন্য দু-চার দিন, এক সপ্তাহ বা পনেরো দিন এসব রোডম্যাপ বাদ দিয়ে এখন দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের বিষয়টি মাথায় রেখে এগোচ্ছেন দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। তারা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ অবস্থান ও প্রশাসনের নানামুখী তৎপরতার মুখে বিএনপির আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। কারণ, হরতাল অবরোধকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে বিএনপির প্রথম ও দ্বিতীয় সারির অনেক নেতাই গ্রেফতার হয়েছেন। গা ঢাকা দিয়েছেন তৃতীয় পর্যায়ের নেতারাও। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে। এ ছাড়া হরতাল, অবরোধ অব্যাহত থাকলেও একপর্যায়ে সাধারণ মানুষ সব আতঙ্ক পাশ কাটিয়ে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরে আসবে। এতে সরকার বিরোধীদের আন্দোলন চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক নেতা জানান, বিএনপির রাঘববোয়াল সব নেতা গাঢাকা দিলেও নিজ নিজ এলাকার কেউ কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় মদদ দিচ্ছেন। তাদের আটক করতে পারলেই অগ্নিবোমা ছোড়ার মতো নৃশংস ঘটনা আর ঘটবে না। এ ছাড়া বোমা মারতে মারতে সরকারবিরোধীরা এক সময় কান্ত হয়ে আপনা আপনিই থেমে যাবে। এতে একপর্যায়ে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এ জন্য যত সময় লাগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে থাকবে। আর কাক্সিত লক্ষ্য অর্জনে সরকার নানা কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
অন্য এক নেতা বলেন, পাকিস্তানে এত জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সত্ত্বেও ওই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। তাই এসব জঙ্গি হামলা অব্যাহত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে। এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই।
খালেদা জিয়াকে একঘরে করে রাখা : দলীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিরোধী জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একাধিকবার গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়া হলেও আপাতত সে দিকে না গিয়ে তাকে একঘরে করে রাখা হবে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা, গুলশান কার্যালয়ের খাবার সরবরাহ বন্ধ, নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে প্রবেশে বাধা দেয়া হচ্ছে। ওই কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের দেখলেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। এতে এক দিকে পরোক্ষ চাপ এবং অন্য দিকে খালেদা জিয়াকে একঘরে করে রাখা হচ্ছে। আর চলমান আন্দোলনের পুরোটা সময়ই এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক সহিংসতাকে ‘জঙ্গি’ হিসেবে উপস্থাপন : দেশব্যাপী চলমান রাজনৈতিক সহিংসতাকে ‘জঙ্গি’ হিসেবে উপস্থাপনের কৌশল নিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্যে চলছে সিডি ও ডিভিডিসহ তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ। তথ্যচিত্র তৈরি হলে তা বিদেশী দূতাবাসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরাম ও সংস্থায় সরবরাহ করা হবে। লাগাতার অবরোধসহ সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে জাতিসঙ্ঘসহ বিদেশীদের আনুকূল্য পেতেই এ কৌশল নেয়া হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এর আগে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে দেশব্যাপী চলা সহিংসতার ভিডিওচিত্র নির্মাণ করে একইভাবে বিদেশী দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থাসহ সারা দেশে মাঠনেতাদের কাছে সরবরাহ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সংলাপের উদ্যোক্তাদের বিতর্কিত হিসেবে উপস্থাপন : চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের বিতর্কিত হিসেবে উপস্থাপনের কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকারবিরোধী জোটের সাথে আপাতত কোনো ধরনের সংলাপ বা সমঝোতায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত থাকায় এ কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। সে জন্য সুশীল সমাজের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে উল্টো তাদের প্রত্যক্ষ সমালোচনায় মেতেছেন প্রধানমন্ত্রীসহ দল ও সরকারের সিনিয়র নেতা-মন্ত্রীরা। সুশীলসমাজকে এক এগারোর কুশীলব আখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে, সুশীলসমাজ নামধারী এসব ব্যক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমেছেন। তাই তাদের সংলাপ প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে নামানো : পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে নামাচ্ছে সরকার। নীতিনির্ধারকদের মতে, এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে এক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কান্ত হয়ে পড়বেন। অন্য দিকে দলীয় নেতাকর্মীরাও ঝিমিয়ে পড়বেন। সে জন্য শুধু প্রশাসনের ওপর ভরসা করে বসে না থেকে দলীয় রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে নেতাকর্মীদেরও মাঠে নামানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা সব এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন। পাড়া মহল্লায় নেতাকর্মীদের দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে দলকে শক্তিশালী করতে আগামী মার্চের মধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ শাখাগুলোর সম্মেলনের কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। শিগগিরই ঢাকা মহানগরের বিভক্ত কমিটি ঘোষণার সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়েছেন তিনি।
জনমত গঠন : আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির প্রায় দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চলা অবরোধে রাজনৈতিক কর্মীর চেয়ে সাধারণ মানুষই বেশি তিগ্রস্ত হয়েছেন। সেই অনুভূতি কাজে লাগিয়ে পোস্টার, লিফলেট, ইন্টারনেট ও সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিএনপি বিরোধী প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলেরা নেতারা বিভক্ত হয়ে ওই প্রচারণায় অংশ নেবেন। ইতোমধ্যে রাজধানীসহ দেশজুড়ে মানববন্ধন করা হয়েছে। শিগগিরই মহানগর, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক আরো কিছু কর্মসূচি পালন করা হবে। তবে সহিংসতার শিকার এলাকাগুলোতে সভা, সমাবেশের মাধ্যমে ওই প্রচারণা বেশি চালানো হবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন : চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি জোটের আন্দোলনের মোড় ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই এ কৌশল নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
কূটনৈতিক তৎপরতায় নজর : তবে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘসহ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটিশ হাইকমিশন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একের পর এক বিবৃতিসহ নানামুখী তৎপরতা নিয়ে খানিকটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলে। সরকারের মন্ত্রী ও দলের বিভিন্ন নেতারা বিষয়টি পাত্তা না দিয়ে মুখে যাই বলেন না কেন প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন। দলের মধ্যমপন্থী নেতারা কূটনৈতিক চাপকে আমলে নেয়ার পরামর্শ দিলেও তা নাকচ করে দিয়েছেন অপেক্ষাকৃত কট্টরপন্থী নেতারা। এসব আমলে না নিয়ে একতরফা নীতিতেই এগিয়ে যাওয়ার পইে মত ওই পটির।
তবে সিনিয়র নেতাদের মতে, কূটনিতিকদের নতুন এ দৌড়ঝাঁপের বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ প্রতিদিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির যে হানাহানির চিত্র প্রকাশ হচ্ছে তা দেশের ভাবমর্যাদার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। শুরুতে সরকার শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করলে দিন যতই যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে। এর শেষ কোথায় তা কেউ অনুমান করতে পারছে না। জাতিসঙ্ঘসহ অন্যান্য মহল বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সত্যিকারের চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলে তা সরকারের সব পরিকল্পনা মাটি করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই কূটনীতিকদের এই দূতিয়ালি কত দূর গড়াতে পারে সেটি পর্যবেক্ষণ করছে সরকার।
চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি নয়া দিগন্তকে বলেন, এটি কৌশলের বিষয় নয়। তারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী আচরণ করছে। তাই তাদের দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। তবে কোনো সময়সীমা দিয়ে সন্ত্রাস নির্মূল করা সম্ভব নয়। কারণ বিএনপি-জামায়াত জোটের শতকরা ৩০ ভাগ ভোট আছে, লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক আছে, তারা যদি জঙ্গিতে রূপ নেয় তাহলে তা নির্মূল করতে সময় প্রয়োজন। এটি চলমান প্রক্রিয়া।
আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: দীপু মনি এমপি বলেন, শুধু প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের সমাধান হবে না। এটি স্থায়ীভাবে নির্মূল করতে জনগণকেও সচেতন হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আর ইতোমধ্যেই তা শুরু হয়ে গেছে। তবে সারা দেশে জনগণকে আরো সম্পৃক্ত করতে বিভিন্ন সভা, সমাবেশ, সেমিনার, লিফলেট ও পোস্টারসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে আওয়ামী লীগ।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের হরতাল, অবরোধ ব্যর্থ হয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সময়ের একপর্যায়ে ককটেল ও পেট্রলবোমাবাজরাও কান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যাবে। সেই সময় পর্যন্ত জনগণকে একটু ধৈর্য ধারণ করতে হবে।