টানা আন্দোলনে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মাঝে ক্লান্তি ভর করছে। সঙ্গী হয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর গ্রেপ্তার আতঙ্ক। ফলে নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ ঘরছাড়া। সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে চলতি আন্দোলন আর কত দিন চালাতে হবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট বার্তা নেই। সরকারকেও নমনীয় করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দলের মাঠ নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।
বিএনপির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, তাঁরাও বিষয়টি নিয়ে কিছুটা চিন্তিত। তবে এখনই আন্দোলন থেকে সরে আসার কোনো চিন্তা তাঁরা করছেন না। কারণ তাঁরা মনে করছেন, আন্দোলন থেকে সরে এলে সংলাপ-সমঝোতার জন্য যে চাপ তৈরি হচ্ছে তা আর পূর্ণতা পাবে না।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট গত ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছে। পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মেয়াদের হরতাল। এখন পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ৫০ দিন অবরোধ পালন করেছে বিএনপি। দলটি বলছে, বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
বাংলাদেশে এত বেশিদিন একটানা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কোনো নজির নেই। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানে সম্প্রতি এর চেয়েও বেশি সময়ের টানা আন্দোলন দেখা গেছে। তবে দাবি আদায় হয়নি। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফের পদত্যাগের দাবিতে গত বছরের ১৪ আগস্ট থেকে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ পাকিস্তান (পিটিআই)। টানা চার মাস অবস্থান করে কোনো ধরনের সাফল্য ছাড়াই গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর তাদের কর্মসূচির সমাপ্তি টানেন ইমরান।
বিএনপি তাদের এই কর্মসূচির মধ্যে বিশ্ব ইজতেমা, এসএসসি পরীক্ষা এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারিতেও কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। বিএনপি বলছে, বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো বিএনপি-জোটের আন্দোলন কার্যকরতা হারাচ্ছে। নেতা-কর্মীরা মাঠে থাকছেন না। যত দিন গড়াচ্ছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা ছড়াচ্ছে। রংপুর জেলা বিএনপির একজন নেতা সম্প্রতি রংপুরে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফুল হককে বলেন, একটানা অবরোধ তাঁদের আর ভালো লাগছে না। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে বাড়িতে পুলিশ যায়। এভাবে আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রে নেতা-কর্মীদের মনে হতাশা ছড়াচ্ছে। হতাশার কথা একাধিক নেতা স্বীকার করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক পর্যায়ের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, কর্মীদের মনোবল ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পর্যাপ্ত টাকা-পয়সাও তাঁদের দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আজ এক জায়গায়, কাল আরেক জায়গায় এভাবে থাকতে হচ্ছে। তাঁরা জানতে চান, আর কত দিন এভাবে চলবে।
এর পাশাপাশি মাঠে নেতা-কর্মীদের কাছে আরেকটি আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’। বিএনপির আন্দোলনের মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যাও বাড়ছে। এঁদের একটি বড় অংশ বিএনপি, ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরের কর্মী। বিএনপি গত সোমবার দাবি করেছে, ঝিনাইদহে যে দুজন গুলিতে নিহত হয়েছেন, তাঁরা বিএনপির কর্মী। রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সভাপতিকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
সম্প্রতি ফাঁস হওয়া নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার টেলিফোন আলাপেও নেতা-কর্মীদের ক্লান্তির বিষয়টি উঠে এসেছে। সাদেক হোসেন খোকাকে বলতে শোনা যায়, ‘কিছু কিছু ডিস্ট্রিক্ট থেকে বোধ হয়, একটু বিরক্ত …মানে। এখন ধরেন মুভমেন্ট চালানো, প্রতিদিন একটা হিউজ কর্মযজ্ঞ হয়। একটা মানুষ জেল-জুলুম পালায়া থাকা, এই করা, সেই করা, আবার অ্যাকটিভিটিজ করা, এটার জন্য জোগান দেওয়া, এগুলো একটু ইয়ে হয়ে আসছে আরকি।’
আলাপচারিতার আরেক পর্যায়ে খোকা বলেন, ‘অ্যাকচ্যুয়ালি আমাদের জেলা পর্যায়ে বা অন্যান্য দিকে নিচের দিকে যে নেতা-কর্মীরা আছে, ওরা তো প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল। ওরা তো এগজস্টেড হয়ে যাচ্ছে। এখন এটা কত দিন কনটিনিউ করা যাবে। আবার না করেও তো কোনো উপায় দেখছি না।’
মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন বলে মনে করেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নেতা-কর্মীরা মানসিকভাবে সাংঘাতিক চাঙা তা বলব না। তবে সারা দেশে নেতা-কর্মীরা ‘স্ট্রাগল’ করছেন। সারা দেশ বিচ্ছিন্ন। নেতা-কর্মীদের ওপর জেল-জুলুম হচ্ছে। তাই হতাশা যে একেবারে নেই তা না। হতাশা না হলেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক, সংশয় কাজ করছে।’
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, তাঁরা মনে করছেন, তাঁদের এই আন্দোলনের ফলে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংলাপের কথা বলছে। যদিও সরকার অনড় অবস্থান দেখাচ্ছে, তবু বিএনপি মনে করছে সরকার বাড়তি চাপে আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদীয় প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর শেষে বলেছে, শান্তি রাজনৈতিক অধিকারের বিনিময়ে নয়। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে সংকট নিরসনের পরামর্শ দিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব দুই নেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। দেশের ভেতরও নাগরিক সমাজ সংলাপের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। এ সবকিছু বিএনপিকে আশার আলো দেখাচ্ছে। বিএনপি নেতাদের মূল্যায়ন হলো, এই অবস্থায় আন্দোলন থেকে সরে আসা হবে ভুল। গতকালও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
এস.কে এম