গ্রেফতার ও কারাবরণসহ যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির সংবাদ শোনার পর তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। বরং তার সঙ্গে কার্যালয়ে অবস্থানকারী দলীয় নেতা ও স্টাফদের নিজেই শান্ত্বনা ও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
কার্যালয় সূত্র জানায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বুধবার দুপুরে তার বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানার সংবাদ খালেদা জিয়া দুপুরেই পান। আইনজীবীদের কাছে এ সংবাদ জেনে তাৎক্ষণিকভাবে গুলশান কার্যালয়ে ছুটে যান তার ভাই সাঈদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরীন এস্কান্দার ও অপর ভাই শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। তারাই প্রথম তাকে এ সংবাদ জানান। তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এ সংবাদ গ্রহণ করেন। এ সময় কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থানকারী কয়েক নেতা তার কাছে যান।
তিনি তাদের বলেন, ‘আপনারা কি চিন্তিত? আমি চিন্তিত নই। রাজনীতির ইতিহাসে এমন প্রতিহিংসা নতুন কোনো ঘটনা নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে জেল-জুলুমও নতুন কিছু নয়। তবে সরকারকে মনে রাখতে হবে, এসব করে তারা পার পাবে না। জনগণের কাঙ্খিত মুক্তি ও দেশের গণতন্ত্র না ফেরা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলবে। চলমান আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে। সেজন্য সবাইকে আরও অনেক কষ্ট করতে হবে। আপনারা কি কষ্ট করতে পারবেন’?
দলীয় প্রধানের এমন জিজ্ঞাসায় নেতারা হাসি মুখে তাকে সায় দেন। এ সময় তিনি দলের নেতা ও তার কর্মকর্তাদের সাহস, শান্ত্বনা ও সাহস দেন। সঙ্গে কিছু নির্দেশনাও দেন তাদের। দীর্ঘ প্রায় দুই মাস ধরে অমানসিক কষ্ট সহ্য করে তার সঙ্গে অবস্থান করায় তিনি কার্যালয়ের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল জানান, ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) বলেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন নই। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্যই আমি আন্দোলন করছি।’
সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গ্রেফতারের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছেন। তাকে যেকোনো সময় গ্রেফতার করা হবে এমন আশঙ্কা নিয়েই তিনি গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। আন্দোলনের চরম মুহূর্তে যেকোনো সময় তাকে যে গ্রেফতার করা হতে পারে সে কথা তিনি আগেই দলের একাধিক নেতাকে বলেছিলেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তার জামিন বাতিলের পর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ইতোমধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা পৌঁছে গেছে গুলশান, রমনা ও ক্যান্টনমেন্ট থানায়। তাকে গ্রেফতার করা এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা ও সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এদিকে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির সংবাদ পেয়ে গুলশান কার্যালয়ে ছুটে যান তার মেজ বোন সেলিনা ইসলাম। এরপর থেকে পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গেই অবস্থান করছেন।
গত ৬ই ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আমি সকলকে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, কোনো অনৈতিক চাপ বা ভীতির মুখে আমি নত হবো না ইনশাল্লাহ্। যেকোনো পরিস্থিতি বা পরিণতির জন্য আমি তৈরি আছি।
খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে গ্রেফতার ও কারাবাসের ঘটনা নতুন কিছু নয়। স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে তিনি তিনবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। প্রথম গ্রেফতার হন ১৯৮৩ সালের ২৭ নভেম্বর। দ্বিতীয়বার তাকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৮৪ সালের ৩ মে। এছাড়া ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর হোটেল পুর্বানীতে খালেদা জিয়া আশ্রয় নেওয়ার পর পুলিশবাহিনী তাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায় এবং বাড়িতে অন্তরীণ করে রাখে।
সর্বশেষ ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের বিশেষ সরকার তাকে গ্রেফতার করে। সে সময় এক বছর এক সপ্তাহ কারাবন্দি থাকার পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। বর্তমানে যে মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে সেই মামলাটিও ওই বিশেষ সরকারের আমলে দায়ের করা।
এদিকে, বিগত আওয়ামী মহাজোট সরকারের আমলে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরের আগে তিনি গুলশানের ভাড়া বাড়ি ‘ফিরোজা’তে অবরুদ্ধ ছিলেন। এরপর গত ৪ জানুয়ারি রাত থেকে বুধবার পর্যন্ত মোট ৫৩ দিন যাবত অনেকটা ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে আছেন গুলশান কার্যালয়ে। এর মধ্যে তার জীবনে অনেক দুর্যোগ এসেছে। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেছেন। তারও আগে তিনি তার জীবনের চল্লিশ বছরের স্মৃতি-বিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকেও উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন। হারিয়েছেন মা তৈয়বা মজুমদার ও ভাই সাঈদ এস্কান্দারকে।
তার সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, আন্দোলন সংগ্রামের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার মনোভাবের সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি। জেলে যাওয়া নিয়েও তিনি মোটেই শঙ্কিত নন। বরং জেলে যেতে হতে পারে এমন প্রস্তুতি তার শুরু থেকে ছিল।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে পড়বে যে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে ক্ষমতাসীনরা একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। যা কোনোভাবেই আর্ন্তজাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বরং সরকারের ওপর নানামাত্রিক চাপ বাড়তে থাকবে।
অপরদিকে, বিরোধী দলের টানা অবরোধ ও হরতাল আরও প্রলম্বিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে। আন্দোলন যাতে নতুন মাত্রা পায় সেদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সর্তক দৃষ্টি রাখছেন।
উল্লেখ্য, গত ৪ জানুয়ারি থেকে গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ৫৩ দিন কেটে গেছে খালেদা জিয়ার। চলাফেরার সীমাবদ্ধতা, ঘুম ও বিশ্রামের অসুবিধা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, নিরাপত্তা হুমকি এবং গ্রেফতারের সকল ঝুঁকি নিয়েই কার্যালয়ে অবস্থান করছেন তিনি।
এমনি নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে গত ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। পুত্র শোকে যখন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তখন অবরোধের সময় বাসে পেট্রোল বোমা হামলা ও হত্যার ঘটনায় তাকে হুকুমের আসামি করে দায়ের করা হয়েছে অন্তত অর্ধ ডজন মামলা। কার্যালয় ঘিরে পুলিশের উপস্থিতিতেই দিনের পর দিন ঘেরাও-বিক্ষোভ-মিছিল করছে সরকারদলীয় বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, পেশাজীবী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, শ্রমিক, এমনকি সরকারের মন্ত্রীরাও।
এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও খালেদা জিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দেন যত কিছুই হোক তিনি কার্যালয় ছাড়বেন না।