উৎসবের নয়, হতাশার নির্বাচন

0

nirbaconঢাকা: তিন সিটির নির্বাচন নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল যুক্তিসংগত। সরকারি দলের বেপরোয়া শক্তি প্রদর্শন, বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের প্রতি প্রশাসনের বৈরি আচরণ, নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে আগেই ঘোর সন্দেহ তৈরি হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত সন্দেহবাদীরাই বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, জাল ভোট, ভোটদানে বাধা, সন্ত্রাস, সরকারবিরোধীদের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিন সিটিতেই বেশিরভাগ মেয়রপ্রাথী নির্বাচন বর্জন করেছেন। সাধারণ মানুষও হতাশা প্রকাশ করেছেন।

তবে সকাল পর্যন্ত বিপরীতটাই আশা করেছিলেন মানুষ।

এ নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা দেশের সীমা ছাড়িয়ে বাইরেও পৌঁছে গিয়েছিল। মাত্র দুইটি শহরের স্থানীয় নির্বাচন হলে কী হবে, জাতিসংঘ-যুক্তরাষ্ট্রও চোখ রাখছিল সেটির ওপর। এ যেন জাতীয় নির্বাচনের আমেজ। সারাদেশের মানুষও তাকিয়েছিল এর দিকে। অবশ্য সবার মাঝে উদ্বেগ ছিল যে মানুষ ঠিকঠাক মতো ভোট দিতে পারবে কিনা। সরকার বা সরকারি দল তাতে হস্তক্ষেপ করে কিনা, নির্বাচন কমিশন কী ভূমিকা পালন করে তা দেখতে সবাই আগ্রহী ছিলেন।

ভোটারদেরকে ইসির পক্ষ থেকে অব্যাহতভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে আশ্বস্ত করা এবং বিভিন্ন দেশের চোখ নির্বাচনে থাকার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আশা ছিল হয়তো ভোটের দিন হয়তো তাদের অধিকারটুকু নির্বিঘ্নে প্রয়োগ করতে পারবেন। তাই অনেকে মঙ্গলবার সকালে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তারা যা দেখেছেন তাতে গত কয়েকদিনে তৈরি হওয়া উৎসাহ দপ করে হতাশায় পরিণত হয়। একটি ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন দেখার তাদের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে।

পত্রিকা-টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদ বলছে, সকালে প্রচুর মানুষ বিভিন্ন কেন্দ্রে গেলেও পুলিশের সহায়তায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে ভোট না দিয়েই ফেরত আসতে বাধ্য হন। অনেকে জাল ভোটের উৎসব দেখে নিজে থেকেই বাসায় ফিরে যান। বহু লোক কেন্দ্রের আশপাশের এলাকা থেকে ফিরে গেছেন ছাত্রলীগের অস্ত্র ও ককটেলবাজির ভয়ে। বহু কেন্দ্রে বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেয়ার পরও নিজেদের বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষ ও অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেছে।

অবশ্য ভোটের দিন এমন হতাশাজনক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া গিয়েছিল গত ২৩ এপ্রিলই। ওইদিন নির্বাচন কমিশন তাদের আগের দিনের সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে। আর নির্বাচনের আগের রাত ১০টার দিকে উত্তরার একটি কেন্দ্রে পুলিশের পাহারায় আওয়ামী লীগের এক কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজনের ব্যালটে সিল মারার ঘটনা যখন তারই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ধরলেন তখনই আসন্ন পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেকেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন।

যারা এসব ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ধরে নিয়ে কেন্দ্রে গিয়েও নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেননি তারা চরম হতাশ। ভোট দিতে কেন্দ্রে গিয়ে সরকারপন্থীদের দেদারসে জালভোট দেয়া উৎসব দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মামুন আহমেদ বলেন, ‘এটি ভোট নয়, প্রহসন। ভোটের আয়োজন আছে, কিন্তু সঠিক ভাবে ভোট দেয়ার আয়োজন নেই। প্রতারণা করার সুযোগ অবারিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘পুলিশ-র্যা ব যার হাতে আছে সে সবই করতে পারে।

পাশাপাশি হতাশ সুশীল সমাজ এবং বিদেশি কূটনীতিকরাও।

মঙ্গলবার দুপুরেই নির্বাচনের চরম পর্যায়ের অনিয়ম এবং তার প্রেক্ষিতে বিএনপির বর্জনের ঘটনায় ‘হতাশা’ প্রকাশ করেছেন ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকেট।

তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল। দুপুরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে এ প্রতিক্রিয়া জানান তিনি। বার্নিকাট ওই কেন্দ্রে ৪০ মিনিট অবস্থান করে পুরুষ ও মহিলা কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ প্রত্যক্ষ করেন। এসময় ২৫ মিনিটে মাত্র ৪ জন ভোট প্রদান করেন। ওই সময়ে পুরুষ বুথে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনো এজেন্ট ছিল না।

এক টুইটার বার্তায়ও হাতাশা প্রকাশ করে বার্নিকেট বলেন, ‘বাংলাদেশে সিটি নির্বাচন থেকে বিএনপি সরে যাচ্ছে, এটা হতাশাজনক।’ এরপরে আরেকটি টুইটে তিনি মন্তব্য করেন, ‘যে কোনো মূল্যে জয় আদৌ কোনো জয় নয়।’

ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডব্লিউ গিবসনও ভোটে অনিয়ম ও বিএনপির বর্জনের ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি অনিয়মের সব অভিযোগ দ্রুত ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন সরকারের প্রতি।

সামাজাকি যোগাযোগের বিভিন্ন সাইটে অনেক ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদুল হক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কার্জন হলে ভোট দিয়ে আসলাম। ইলিশের ছড়াছড়ি, অন্য কিছুই নেই। যেন একদলের নির্বাচন চলছে। কেবল নির্বাচনমুখী যে গণতন্ত্র ছিল তাও হারিয়ে যাচ্ছে।’

তরুণ লেখক জিয়া হাসান মঙ্গলবারের নির্বাচনকে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সাথে মিলিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে লিখেছেন, ‘সালাদের লোভ যে ছাড়তে পারেনা, সেকি কাচ্চির লোভ ছাড়তে পারে?’

এদিকে সরকারি দল ‘ভোট ডাকাতি’র অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করেছেন প্রায় সব বিরোধী দলের প্রার্থীরা। ঢাকা দক্ষিণ, উত্তর এবং চট্টগ্রামের তিন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীই দুপুরের পর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।

পরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, নির্বাচন থেকে আমরা সরে এসেছি। এই নির্বাচন কোনো নির্বাচন হয়নি। কী হয়েছে, আপনারা সবাই জানেন। তিনি বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ভোট দখল, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া, ব্যালটবাক্স দখল, ভোটারদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে ধরেন।

মওদুদ আহমদ বলেন, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে। ভোটারদের হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই চিরকুট থাকলে তাদের ভোট দিতে যেতে দেওয়া হচ্ছে। না থাকলে ভোট দিতে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোটও পড়েনি বলে মন্তব্য করেন মওদুদ।

৩ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরাও বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যাপক কারচুপি ও সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্র দখলের প্রতিবাদে এই ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী ও বামপন্থী রাজনীতিক জোনায়েদ সাকীও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। দুপুরে নিজ নির্বাচনী কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাকী বলেন, যেভাবে কেন্দ্র দখল করা হয়েছে, ব্যালট ছিনতাই করা হয়েছে। তাতে এই ভোট ও ফল মেনে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। এ কারণে আমি নির্বাচন ও ফল প্রত্যাখ্যান করছি।

স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী গোলাম মাওলা রনিও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। ফেসবুকে এক স্টাটাসে রনি লেখেন, ‘অন্যসব প্রতিযোগীর মত আমিও এই নির্বাচন বর্জন করলাম। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন টিভিতে দেখছিলাম, আর ২৮ এপ্রিলের নির্বাচন চর্মচক্ষে দেখলাম। এও কি সম্ভব! ইয়েস,  রংগে ভরা বঙ্গে সবই সম্ভব।’

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More