ঢাকার মানুষজন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ওপর বাস করছে। মাকড়সার জালের মতো গ্যাসের লাইনে আচ্ছাদিত এই ঢাকা শহর। কোনো দিন শক্তিশালী ভূমিকম্প হলেই গ্যাস লাইনগুলো ফেটে যাবে। ভূমিকম্পে বিদ্যুতের খুঁটিও ভেঙে পড়ে, যেমনটি নেপালে হয়েছে। এই বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে স্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেই অবস্থায় ওপরে আগুন, নিচে দাহ্য গ্যাস- দুইয়ে মিলে ঢাকা এক অগ্নিকূপে রূপ নেবে।
আমরা ১০-১৫ বছর ধরেই এ বিষয়ে বলে যাচ্ছি। বর্তমান সরকারের বিগত আমলে ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক যখন দুর্যোগবিষয়ক মন্ত্রী, তখন গ্যাস লাইনে অটোসেন্সর লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল; জামিলুর রেজার নেতৃত্বে সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল সংযোজনের। এই সেন্সর ইলেকট্রিক সার্কিট ব্রেকারের মতো। কম্পন নির্ধারিত মাত্রার ওপরে গেলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। ক্যালিফোর্নিয়াসহ ভূমিকম্পপ্রবণ বিভিন্ন নগরীতে এ ধরনের ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আমাদেরও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম ছিল সরবরাহ এলাকাগুলোকে অঞ্চলে ভাগ করে অটোসেন্সর লাগানো। কিন্তু বাস্তবায়িত হলো না।
ঢাকা নগরীতে ৭৮ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে সরকারিভাবেই চিহ্নিত। সব কটি না হোক, ৭৮টি ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনা’ যদি ঢাকায় ঘটে, অবস্থা কী হবে? ভূমিকম্পে আঘাতপ্রাপ্তদের চিকিৎসা দিতে হবে। কিন্তু বড় ভূমিকম্প হলে অন্য অনেক ভবন ভাঙার আগে ঢাকা নগরীর দুটো প্রধান সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) নিজেই ভেঙে পড়বে। সচিবালয়ের কিছু ভবনও ভেঙে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন। সিদ্ধান্ত হয়েছিল এ ধরনের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে ‘রেট্রোফিটিং’ করে শক্তিশালী করার। কাজটি আর এগোয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের সরঞ্জামসহ কর্মীরা যে ভবনগুলোতে অবস্থান করেন, সেগুলোও মজবুত নয়। তার মানেই হচ্ছে, বড় ভূমিকম্প হলে তাঁরা যন্ত্রপাতিসমেত চাপা পড়বেন। তাহলে উদ্ধার হবে কী দিয়ে, কাদের দিয়ে? ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পরিবারের আবাসনব্যবস্থারও নিরাপত্তা দরকার। নিজেদের পরিবার দুর্ঘটনাকবলিত হলে কর্মীরা কিভাবে কাজ করবেন? স্বজন-পরিজন গুরুতর অসুস্থ হলে অন্যকে চিকিৎসা দেওয়ার শক্তি কি সব ডাক্তারের থাকে? দমকল বিভাগের গাড়ির আধুনিকায়ন করার কথা ভাবা হয়েছিল। ৭৮ হাজার ভবন ভেঙে পড়লে সেগুলোর উদ্ধারকর্মে কী কী লাগবে, তার তালিকা দেওয়া হয়েছিল। এর প্রায় কিছুই জোগাড় হয়নি।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনা আমরা দেখেছি। একটি ভবনের উদ্ধারকর্মে অনেক সপ্তাহ লেগে গেল, ৭৮টি, ৭৮০০ বা ৭৮ হাজার ভবন যদি বিধ্বস্ত হয়, তখন? রাজউকের দায়িত্ব হচ্ছে, এ ধরনের ভবন চিহ্নিত করে ভেঙে ফেলা এবং নির্মাণকাজ তদারক করা। দায়িত্বটি তারা পালন করছে না। বরং জমির ব্যবসা, ফ্লাইওভার নির্মাণ- এসবেই তারা বেশি আনন্দ পায়। জামা-প্যান্টের বদলে টাইয়ের প্রতিই যেন রাজউকের বেশি আগ্রহ।
ভূমিকম্পে আটকে পড়া একজন মানুষ বড় ধরনের আঘাতপ্রাপ্ত না হলে ২১ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার ইতিহাস রয়েছে। তাই হুড়োহুড়ি করে নামার চেষ্টা না করে বরং কোথায় আশ্রয় নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পানি, চিঁড়ার মতো শুকনো খাবারের জোগাড় দুুর্যোগকালীন অবস্থার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে জোর প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে গণমাধ্যমে; যেমন- প্রতিদিন সংবাদপত্রগুলোতে ছোট করে স্লোগান ছাপা যেতে পারে। সরকারি-বেসরকারি টিভিতে দু-এক মিনিটের ভিডিও প্রচারিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে করপোরেট হাউসগুলোও মিডিয়াকে সহযোগিতা করতে পারে।
আরেকটি ব্যবস্থার কথা আমরা বারবার বলছি। রাজধানীর বেশির ভাগ বহুতল ভবনের জানালায় সাধারণ গ্লাস ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বাধ্যতামূলক করা উচিত টেমপারড গ্লাস লাগানো; এ ধরনের গ্লাস গাড়িতে লাগানো হয়। ভাঙলে গুঁড়ো হয়ে যায় বলে এগুলো নিরাপদ। বসন্ধুরা সিটিতে এ গ্লাস ছিল বলেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গ্লাস ভেঙে পড়লেও নিচে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এই গ্লাস যেখানে দানা দানা হয়ে পড়ে, সাধারণ গ্লাস পড়ে তলোয়ারের মতো, ছুরির মতো। ফলে গ্লাসবিদ্ধ হয়েও হতাহত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। তাই ভবনগুলোর কাচ সেলোফিন কাগজ দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে আপাতত, যেমনটি করা হয় গাড়ির কাচ ডার্ক করার জন্য। তবে এ ব্যবস্থাটি হবে সাময়িক, শেষ পর্যন্ত সরিয়ে ফেলারই কঠোর নির্দেশনা দিতে হবে।
এ ছাড়া শিল্প গ্যাসের লাইন ছাড়া সব ধরনের আবাসিক, হোটেল প্রভৃতির লাইন স্থায়ীভাবে বন্ধ করে, গ্যাসের পাইপলাইন বন্ধ করে সবার জন্য সিলিন্ডার ব্যবস্থা চালু করার কথা আমরা বলে আসছি। সারা দেশের সবার জন্য সিলিন্ডার সরবরাহের স্বার্থে প্রয়োজনে ভর্তুকিরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে ঝুঁকি যেমন কমবে, জনগণ চলে আসবে এককাতারে; ঘুচবে বৈষম্য।
বড় ভূমিকম্পে পানির সরবরাহ লাইনও ভেঙে পড়ে। ঢাকা যেহেতে মাঝারি ভূমিকম্প জোনের মধ্যে পড়েছে, এ ধরনের দুর্যোগের পর পানির সংকট হবে। তাই সঞ্চিত পানির ব্যবস্থা থাকা উচিত। খালবিল-নদীনালা পরিচ্ছন্ন রাখা গেলেও সে পানি ফিল্টার করে খাওয়ানো যেত, যেমনটি এখন সম্ভব হাতিরঝিল থেকে। আর ভূগর্ভস্থ কাঠামোতে ফাটল হয় তুলনামলক কম। পান করা ছাড়াও আগুন নেভানোর জন্যও পুকুরের মতো জলাধারগুলোর প্রতি নজর দেওয়া উচিত।
স্থায়ীভাবে জরুরিকালীন জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে সরকারিভাবে। এগুলোর জন্য স্কুল, পার্ক, ঈদগাহ খেলার মাঠের অংশবিশেষ আমরা ব্যবহার করতে পারি। যে বড় ঝুঁকির মধ্যে আছি, আঘাতপ্রাপ্ত হলে সমগ্র বিশ্বের সহযোগিতা ছাড়া আমরা উদ্ধার পাব কি না জানি না। ৭৮ হাজার ভবন ভেঙে পড়লে ঢাকার বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে অন্য কোথাও নিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে। কারণ উদ্ধার তৎপরতা শেষ করতে কত বছর লেগে যাবে কে জানে!
লেখক : মোবাশ্বের হোসেন, স্থপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি। টেলিফোনের আলাপচারিতা থেকে অনুলিখন
কালের কন্ঠ