ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত তিন মেয়রকে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আজ বুধবার তাঁরা শপথ নেবেন।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, সরকার নবনির্বাচিত তিন মেয়রকে এ ধরনের মর্যাদা দিতে চায়। এ জন্য আইনি বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অবশ্য এর আগে এ সরকারের আমলে নির্বাচিত নয়জন সিটি মেয়রকে এ ধরনের পদমর্যাদা দেওয়া হয়নি।
স্থানীয় সরকার বিভাগের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মেয়রদের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে আইনে কিছু উল্লেখ নেই। গত বিএনপি সরকারের আমলে আইনবহির্ভূতভাবে এ ধরনের মর্যাদা দেওয়া হয়। তখন ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছিলেন।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার সচিব আবদুল মালেক প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে। তবে এর আগে ঢাকার মেয়র যেহেতু মন্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছেন, তাই বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। শপথের আগে বা পরে বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাঁরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় আছেন। জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনো নির্দেশনা বা সুপারিশ এখনো দেননি। নির্দেশনা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
আজ বুধবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শপথ নেবেন নতুন তিন মেয়র। তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন নবনির্বাচিত কাউন্সিলরদের শপথবাক্য পাঠ করাবেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯০ সালে এরশাদ আমলেই প্রথম নাজিউর রহমানকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়।
২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নির্বাচিত নয়জন সিটি মেয়রকে পদমর্যাদা দেওয়ার কথা উঠেছিল। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মেয়রদের পদমর্যাদা সাংসদের ‘উপরে’ রাখার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠিও দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ঢাকা ছাড়া অন্যান্য মহানগরের সাবেক মেয়ররা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। নতুন মেয়রদের সে রকম কোনো মর্যাদা নেই। এর ফলে তাঁরা সাংসদ ও সচিবদের নিচে অবস্থান পেয়েছেন। তাঁদের কিছুটা উচ্চতর পদমর্যাদা দেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘বিষয়টি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি এখনো কিছু জানি না। তবে অন্যদের যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, আমাদেরও তাই দেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগের গত সরকারের সময় (২০১৩ সাল) অনুষ্ঠিত নয়টি সিটি নির্বাচনের আটটিতেই পরাজিত হন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক, রাজশাহীতে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, বরিশালে শওকত হোসেন এবং সিলেটে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছিল, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়ররা প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদাসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন। একই বিভাগ সাড়ে চার বছর পর এক চিঠিতে বলেছে, ‘মেয়রদের মাসিক সম্মানী ভাতা ও অন্যান্য সুবিধার সঙ্গে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা উপমন্ত্রীর পদমর্যাদার কোনো সম্পর্ক আছে বলে প্রতীয়মান হয় না।’
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। ২০১০ সালের ১৭ জুন এই সরকারের সময়ে প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপির এম মনজুর আলম। এরপর ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর আওয়ামী লীগ-সমর্থিত শামীম ওসমানকে হারিয়ে নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচিত হন সেলিনা হায়াৎ আইভী। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি কুমিল্লায় বিএনপির নেতা মনিরুল হক আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আফজল খানকে পরাজিত করেন। ২০১২ সালের ১৯ ডিসেম্বর রংপুরে সরফুদ্দীন আহমেদ মেয়র পদে বিজয়ী হন।
সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, ২০১১ সালের ৩ নভেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর একটি চিঠি দেয়। এতে বলা হয়, ‘রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়ররা সরকারের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পদমর্যাদা নির্ধারণ করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু পরে আর বিষয়টি এগোয়নি। তাই নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও রংপুরের মেয়ররা প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা পাননি।
২০১৩ সালে রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে বিজয়ী হন বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা। এঁদেরও পদমর্যাদা দেওয়া হয়নি। উল্টো ২০-দলীয় জোটের আন্দোলনের কারণে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে তাঁদের পালিয়ে থাকতে হচ্ছে।
ইতিমধ্যে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও গাজীপুরের মেয়র এম এ মান্নানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলার কারণে রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেনকে বরখাস্তের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে সাংসদ শামীম ওসমানের আনা অভিযোগ তদন্ত করছে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি। তাঁকেও বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
প্রথম আলো