বিরোধী দলের চলমান আন্দোলন এক মাস পার হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ এবং সংলাপ সমঝোতার চাপ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দুর্ভাবনায় ফেলেছে। সরকার মনে করছে আন্দোলন দমনে বহুমুখী কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে অতীতের মতোই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু গত এক সপ্তাহজুড়ে নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংলাপের জন্য চাপ আওয়ামী লীগকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। সরকারি দল বোঝার চেষ্টা করছে, এই দূতিয়ালি কতদূর গড়াতে পারে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের বর্তমান আন্দোলন অতীতের চেয়ে ভিন্নতর। গত এক বছর বিএনপি বড় কোনো কর্মসূচি দেয়নি। সভা-সমাবেশ এবং গণসংযোগমূলক কর্মসূচির মধ্যেই দলটির তৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ৫ জানুয়ারি সরকারের বর্ষপূর্তিকে সামনে রেখে ২০ দলীয় জোট চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। এ আন্দোলনে ইতোমধ্যেই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সরকার কঠোরভাবে আন্দোলন দমনের পদক্ষেপ নেয়ায় খুন, জখম, গুম, হয়রানি এবং গ্রেফতারের মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অতীত অবস্থান থেকে সরে এসে কথা বলা শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহে জাতিসঙ্ঘ, ব্রিটিশ হাইকমিশন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাসহ প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারনেশনাল, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, ইউ এন এইচ সি আর, দ্য এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজএপেয়ারেন্স (এফএডি), এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রভৃতি সংস্থা ও সংগঠন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপও বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে। প্রতিদিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির যে হানাহানির চিত্র প্রকাশ হচ্ছে তা দেশের ভাবমর্যাদার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। চলমান লাগাতার আন্দোলন ৩৮ দিনে পড়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর। শুরুতে সরকার শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি দেশে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং বিদগ্ধজনেরা সঙ্কট সমাধানে সংলাপ ও সমঝোতার দাবি জানাচ্ছেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।
সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও নেতা আলাপকালে নিজেদের উদ্বেগ ও অসহায়ত্বের কথা জানান। সূত্র জানিয়েছে, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্র বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কী বলেছেন সরকার তা জানার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং দেশের অভ্যন্তরের নাগরিক সমাজ সত্যিকারেই ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো উদ্যোগ নিলে সরকারের পক্ষে তা উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিক সমাজের উদ্যোগকে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলপর্যায় থেকে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। সরকারের সমালোচনা সত্ত্বেও বিভিন্ন সংস্থার জরিপে সাধারণ জনগণ বর্তমান পরিস্থিতির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চান বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। উদ্যোগী নাগরিক সমাজের বৃহত্তর অংশের সাথে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের অনেক আগে থেকেই যোগাযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষের এ মনোভাব ধারণ করে সম্প্রতি তারা তৎপরতা শুরু করে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করায় বিষয়টি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত খারাপ ইমেজ সৃষ্টি করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট, মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থাহীনতা সম্পর্কে বাইরের দুনিয়া ওয়াকিবহাল। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে মডারেট দেশ হিসেবে বাংলাদেশেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুনাম ছিল। গত তিন দশকে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা কিছুটা হলেও টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছিল। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে সে সুনাম নষ্ট হয়ে গেছে। সরকার সীমিত গণতান্ত্রিকব্যবস্থা চালু করে উন্নয়নের মডেল তৈরির যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা এখন বিতর্কের মুখে। সরকারের এ পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ কোন জায়গায় গিয়ে ঠেকবে তা অনুমান করা যাচ্ছে না।
জাতিসঙ্ঘসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর নতুন তৎপরতা সরকারকে দারুণ অস্বস্তিতে ফেলেছে। অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের চাপ, নাগরিক সমাজের উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক তৎপরতা সমন্বিতভাবে কাজ করলে সরকারের সব রাজনৈতক হিসাব পাল্টে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।