ঢাকা: বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন। স্বাধীনতার পর বিগত চার দশকে সংগঠনটি সেই ভাবমূর্তি হারিয়েছে। অন্তর্কোন্দল আর ব্যক্তিত্বের সংঘাতে অনেকবার পথহারা হয়েছে। নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষে লিপ্ত। আবার অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতের ওপর খড়গহস্ত হয়ে রক্ষণশীলতা ও সঙ্কীর্ণতার পরিচয় দিয়েছে। গণতান্ত্রিক চেতনাকে উপেক্ষা করেছে।
এসব কিছুর পরও গঠনতন্ত্র অনুসারে নেতৃত্ব নির্বাচনে নিয়মিত কেন্দ্রীয় সম্মেলন করে দায়িত্ব হস্তান্তরের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হয়। যদিও সে ধারাবাহিকতা প্রায়িই ব্যাহত হয়েছে।
সর্বশেষ ২০১১ সালের ১০ জুলাই অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাধ্যমে দায়িত্ব পেয়েছিলেন এসএম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সিদ্দিকী নাজমুল আলম। গঠনতন্ত্র অনুসারে কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ দুই বছর হলেও এই কমিটির বয়স ইতিমধ্যে প্রায় ৪ বছর হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্নের মুখে হচ্ছিলেন দুই নেতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সম্মেলনের বিষয়ে জোর দিচ্ছিলেন। অবশেষে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের ঘোষণা এলো।
গত ৮ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানানো হয়, আগামী ২৫-২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এর মাধ্যমেই নেতৃত্বে আসছে পরিবর্তন।
এর আগে গত কয়েকদিন ধরেই ঢাবি এলাকায় ভেসে বেড়াচ্ছিল কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণার সম্ভাবনার কথা। দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ার আভাস পাওয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে পদ-প্রত্যাশীদের দোড়ঝাঁপ। শুরু হয়েছে তোড়জোড়। নিজের পক্ষে সমর্থন আদায়ে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন তারা। মধুর ক্যান্টিনেও তাদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। সংগঠনের নীতি নির্ধারকদের সর্মথন আদায়ে লবিং করছেন তারা। সেক্ষেত্রে নীতি-নির্ধারকদের বাসায় ধর্ণা দেয়া থেকে শুরু করে প্রাধান্য পাচ্ছে অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতিও। সেই সঙ্গে তৃণমুল নেতাকর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন এসব পদ-প্রত্যাশী।
পদ-প্রত্যাশী কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরাবরের মতো এবারো অঞ্চল রাজনীতি নেতৃত্ব নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলবে। সারাদেশে ছাত্রলীগকে ছড়িয়ে দিতেই দলটির শীর্ষ চারটি পদ (কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে ভাগ করে দেয়া হবে।
ছাত্র রাজনীতিতে অভিজ্ঞ, আনুগত্যশীল, দলীয় আদর্শে বিশ্বাসী ও নেতাকর্মীদের আস্থাভাজন কান্ডারির দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এর আগেও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি ছাত্রলীগের নেতৃত্ব কেমন হবে তার রূপরেখা তুলে ধরেছেন।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও কাজ করে যাচ্ছেন নিজেদের আস্থাভাজনদের নতুন কমিটিতে স্থান করে দিতে। এছাড়াও দলের নতুন নেতৃত্বে নিজ মতাদর্শের ব্যক্তিকে স্থান দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন সাবেক নেতা থেকে শুরু করে মহানগর নেতারাও।
ছাত্রলীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গত কয়েক মাস যাবৎ ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদককে সম্মেলন করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে সভা-সমাবেশেও তিনি কাউন্সিলের বিষয়ে জোর তাগিদ দিচ্ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে পাল্টে যায় ছাত্রলীগের রাজনীতির দৃশ্যপটও। ক্যাম্পাসে পদ প্রত্যাশীরা ক্রমেই হয়ে উঠছে তৎপর। টার্গেট অনুযায়ী কাউন্সিলে নিজের পক্ষে সমর্থন আদায়ে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগও বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা।
এদিকে কয়েকজন সম্ভাব্য পদ-প্রত্যাশীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত তিন বছরে যাদেরকে কখনো দেখা যায়নি কিংবা দুঃসময়ে যাদেরকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি তারাও আজকাল তোড়জোড় শুরু করেছে। মধুর ক্যান্টিনে এদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। আবার অনেকে চুপিচুপি সাবেক নেতাদের বাসায় ধর্ণা দিচ্ছেন। এসব ‘দুধের মাছিরা’ সংগঠনটির ক্ষতি করছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, এবারের সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নেতৃত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ঢাবি শিক্ষার্থী ছাড়া নেতৃত্ব নির্বাচন প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন কিছু নেতা। বহিরাগত কাউকে নেতৃত্বে আনা হলে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়বে বলেই তাদের মত।
নেতৃত্ব নির্বাচনে দেখা হবে তার নেতৃত্ব গুণ এবং দলের জন্যে ত্যাগ। জ্যেষ্ঠতাও মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিগত বছরগুলোতে যারা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন কিংবা দলের বিপদের সময়েও যারা দিয়ে গেছেন শ্রম, ব্যয় করেছেন তাদের মেধা তাদেরকেই বেছে নেয়া হবে।
জ্যেষ্ঠতা এবং দলের জন্যে ত্যাগের দিক থেকে এগিয়ে থাকবেন বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুল কবির রাহাত, পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক সাইফুর রহমান সোহাগ ও ক্রীড়া সম্পাদক আবিদ আল হাসান কিংবা সহ-সম্পাদক আসাদুজ্জামান নাদিম। বিগত বছরগুলোতে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন এরা।
এছাড়াও পদের দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন- কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন আনু, সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক কাজী এনায়েত, কৃষি বিষয়ক সম্পাদক রাইসুল ইসলাম জুয়েল, উপ-আইন বিষয়ক সম্পাদক বিপ্লব হাসান পলাশ ও মানব উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক শাহনেওয়াজ প্রধান শুভ।
এছাড়া কেন্দ্রে আসতে পারেন- উত্তর মহানগর সাধারন সম্পাদক আজিজুল হক রানাও।
আবার নেতৃত্বে তারুণ্য বিবেচনায় আসতে পারেন- ঢাবি শাখা সহ-সভাপতি আরিফুজ্জামান রোহান, ঢাবি সাংগঠনিক সম্পাদক চন্দ্রশেখর হালদার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এইচ এম আল-আমীন কিংবা সিনিয়র সাংগঠনিক সম্পাদক আপেল মাহমুদ সবুজ। এই দৌড়ে আরো আছেন কেন্দ্রীয় উপ-আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ও কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক রুয়েল প্রমুখ।