বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রেম চলছিল দুজনের মধ্যে। গভীর প্রেমে মত্ত হয়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। এরই একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে প্রেমিকা। সঙ্গে সঙ্গেই ভোল পাল্টে যায় প্রেমিকের। বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু প্রেমিক এড়িয়ে চলা শুরু করে। একপর্যায়ে পুরো যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অনাগত সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের দাবি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় প্রেমিকা। কিন্তু কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। শেষে সব হারিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। গত ১৩ই জুন নিজ বাসার সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি টের পেয়ে নিয়ে যান হাসপাতালে। সেখানে ৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার পর মৃত্যুর কাছে হার মানে। ১৯ শে জুন তার মৃত্যু হয় হাসপাতালে। নিহত এ মেয়েটির নাম ফাতেমা-তুজ-জোহরা বৃষ্টি। কাফরুল থানা ছাত্রলীগের ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদিকা ছিলেন তিনি। পড়তেন সরকারি বাংলা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তৃতীয় বর্ষে। আর তার প্রেমিকের নাম এইচ এম জাহিদ সোহাগ। একই কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী ও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি। শুক্রবার বৃষ্টির পরিবারের সদস্যরা জাহিদের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু খবর পেয়ে জাহিদ ও তার সহযোগীরা থানায় গিয়ে বৃষ্টির পরিবারের সদস্যদের হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। মামলা না নিতে চাপ দেয় পুলিশকেও। কিন্তু শেষে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে পুলিশ মামলা নিয়ে গ্রেপ্তার করে জাহিদকে। গতকাল তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের মিরপুর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) কায়েমুজ্জামান বলেন, জাহিদকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। যদি প্রয়োজন হয় তবে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান তিনি।
নিহত বৃষ্টির স্বজন ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৃষ্টি ও জাহিদ দুইজনই ছাত্রলীগের কলেজ শাখার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এর সূত্র ধরেই দুইজনের পরিচয়। পরিচয় থেকে তাদের মধ্যে গড়ে উঠে প্রেমের সম্পর্ক। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ছাত্রলীগ নেতা জাহিদ তার সঙ্গে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক করেন। কয়েক মাস আগে বৃষ্টি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এরপর থেকেই জাহিদ বৃষ্টিকে এড়িয়ে চলা শুরু করে। একপর্যায়ে বৃষ্টিকে বুঝিয়ে অ্যাবরশন করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বৃষ্টি অ্যাবরশন করতে রাজী হয়নি। এরপর থেকে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেয় জাহিদ। কিন্তু মাঝেমধ্যেই জাহিদ তার কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান অনিক, জাহিদ মুন্সি, আবদুল আজিজ ওরফে তানভীর, শাকিল আহমেদ ও চঞ্চল দাসসহ বৃষ্টি ও তার পরিবারকে নানারকম ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। বিষয়টি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করতে নিষেধ করা হয়। এ বিষয়ে গত ২রা মে কাফরুল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে বৃষ্টি। জিডি নং ৭২। কিন্তু আসামিরা ছাত্রলীগ নেতা হওয়ায় পুলিশ বিষয়টি আমলে নেয়নি। নিজে ছাত্রলীগের পদধারী নেত্রী হলেও অন্যায়ের কোনও বিচার না পেয়ে ক্রমেই বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছিলেন বৃষ্টি। অনাগত সন্তানের স্বীকৃতির জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতার কাছেও গিয়েছিলেন তিনি। বৃষ্টির চোখের পানি কারো মনই গলাতে পারেনি। সবাই ‘দেখব’ ‘দেখছি’ বলে লোক দেখানো সান্ত্বনার বাণী শোনান। এমনকি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরাও বিষয়টি জানতেন। তারাও কেউ বিষয়টি সুরাহা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। এমনকি বৃষ্টির মৃত্যুর পরও তার পরিবারের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি।
বৃষ্টির পরিবারের সদস্যরা জানান, পূর্ব শেওড়াপাড়ার ১৩২০ নম্বর বাড়ির ৫ম তলায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন বৃষ্টি। তার বাবা তোফাজ্জল হোসেন একজন ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী। গত ১৩ই জুন জাহিদ ও অনিকসহ অন্যরা বৃষ্টির বাসায় যায়। এ সময় তারা বৃষ্টিকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে। এই অপমান সইতে না পেরে সেদিনই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে সে। পরিবারের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে নিয়ে যায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখান থেকে নেয়া হয় কেয়ার স্পেশালাইজড হাসপাতালে। সেখানেই ৬ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যু হয় তার। পরিবারের সদস্যরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই মেয়েকে গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির কাঠালিয়ায় নিয়ে দাফন করেন। পরে বিস্তারিত জানতে পেরে গত শুক্রবার মামলা করেন। মামলা নম্বর ৮২। মামলায় সরকারি বাংলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান অনিককেও আসামি করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, জাহিদ সরকারি দলের এক এমপির ঘনিষ্ঠ। তার রাজনীতি করার কারণেই এত বড় অন্যায় করেও বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রভাবশালী একজনের বাড়িও জাহিদের এলাকায়। তারও নেপথ্য সহযোগিতা রয়েছে। এদের কারণে পুলিশ প্রথমে মামলাও নিতে চায়নি। পরে মামলা নিলেও কেবল আত্মহত্যার প্ররোচনার ধারাটি উল্লেখ করা হয়েছে। থানায়ও জামাই আদরে ছিলেন জাহিদ। আদালতের মাধ্যমে তাকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কোন রিমান্ডও চায়নি পুলিশ।
এদিকে কাফরুল থানার সামনে থেকে জাহিদকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই একের পর এক হুমকিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নিহত বৃষ্টির পরিবারের সদস্যরা। নিহত বৃষ্টির মামা জুয়েল রানা বলেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের বিভিন্নভাবে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। তারা জাহিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
Next Post