আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে ‘অতিরিক্ত’ আলোচনায় দলের সিংহভাগ নেতাই বিব্রত। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো অভিজ্ঞ ও চৌকস নেতৃত্বের সমান্তরাল করে সাধারণ সম্পাদক পদকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কিছু নেই।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক জ্যেষ্ঠ নেতা মানবকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, সামরিক শাসকদের হাতে গড়া দল বিএনপি বা জাতীয় পার্টির চেয়ারপার্সনদের দল পরিচালনার জন্য চৌকস ও অভিজ্ঞ সাধারণ সম্পাদক দরকার হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা, যিনি সাত বারে, ৩৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতি। এত দীর্ঘ সময় ধরে যিনি দলকে পুনর্গঠিত করেছেন, রাজনীতিতে তার সমান্তরাল করে সাধারণ সম্পাদকের পদকে অতি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কোনো অর্থ নেই।
আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক মানবকণ্ঠকে বলেন, সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে যারা এত আলোচনা-সমালোচনা মাঠে ছাড়ছেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি নিজেই
তৃণমূল পর্যন্ত সবার খোঁজ-খবর রাখেন। সারাদেশের সব জেলার নেতারা দলীয় সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। সেখানে, অন্তত আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাধারণ সম্পাদক পদ এতটা গুরুত্ব বহন করে না।
সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ-বিদেশের সব ঝঞ্ঝাট একাই মোকাবিলা করে দল ও সরকারকে আজ এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। অনেক রথী-মহারথীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পন্ন করে সরকার চালাচ্ছেন। দল আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। ১৯৮১ সালের পর বহুধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন তিনি। তাই সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে এত মাতামাতি করে, তাকে বিব্রত করে এখানে কিছু হবে না। সারাদেশের কাউন্সিলররাও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রেখে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের ভার তার ওপরই দিয়ে দেবেন। তিনিই তার বিশ্বস্ত কাউকে এ পদে নির্বাচন করবেন। এটাই দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ত্যাগী নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই রাখেন। কোন জেলায় কে অসুস্থ, কার পরিবারের কী অবস্থা এসব প্রধানমন্ত্রীর নখদর্পণে। কিছুদিন আগেও দলের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে তিনি ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন।
আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, আওয়ামী লীগের গত সাড়ে তিন দশকের বিজ্ঞ সভাপতি ও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা তার বিচক্ষণতা দিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছেন। তিনি এখন বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ। অধিকতর পরিণত এবং রাষ্ট্র ও দল পরিচালনায় তার সক্ষমতা অনেক উঁচুতে। যা সারা বিশ্বে স্বীকৃত। সুতরাং তিনি তার দলীয় টিম নির্বাচনে কোনো ত্রুটি করবেন না। এই নেতা আরো বলেন, এখানে সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দলের জন্য ভালো একজন সাধারণ সম্পাদক দরকার হতে পারে; কিংবা বহু মত ও আদর্শের মিশেল দল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ সাধারণ সম্পাদক দরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগের ঐক্যের কেন্দ্র, শেখ হাসিনা তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়ন বাস্তবায়নের মিশন এবং ভিশনে শুধু চৌকস নয়; বিশ্বস্ত কাউকেই নির্বাচন করবেন এটাই আমরা চাই।
দলটির নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থাভাজন। ২৮ মার্চের আগামী কাউন্সিলে আগত কাউন্সিলররা তাদের জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা মোতাবেক শেখ হাসিনার প্রতি এবারো আস্থা জানাবেন। বরাবরের মতো তাকেই সভাপতি নির্বাচন করবেন। তার ওপর টিম নির্বাচনের দায়িত্বও অর্পণ করবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এ দল পরিচালনার টিম নির্ধারণ করবেন বঙ্গবন্ধুরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বিশ্বস্ত নেতারাই বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। তবে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে এবং বিগত এক-এগারোর সময়ে দলে কিছুটা সমস্যা দেখা দিলেও তৃণমূল ছিল ঐক্যবদ্ধ।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। পরে ১৯৫৩ সালে দলের প্রথম কাউন্সিল সভা থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফায় জাতির জনক এ দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর পর থেকে চার মেয়াদে দলের সভাপতি ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের বিকাশ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পুরোভাগেই জড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
নিকট অতীতে ১৯৮১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সাতবার দলটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, প্রতিবার সম্মেলনেই সারাদেশের কাউন্সিলররা আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে শুধু সভাপতিই মনোনীত করেন না; দল পরিচালনায় বাকি টিম নির্ধারণের দায়িত্বও দেন শেখ হাসিনাকে। দলের নেতারা বলেন, এ কারণেই সারাদেশের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়তি আবেগ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর বাইরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান চার বার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালে দলের সম্মেলনে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। জিল্লুর রহমানই একমাত্র সাধারণ সম্পাদক, যিনি সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনাকে পেয়েছেন। আর প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৬৬, ’৬৮ ও ’৭০ সালে টানা তিনবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সাতবারের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ৫ জন। তার মধ্যে জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক ও আবদুল জলিল মারা গেছেন। বাকি দু’জন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এখনো তার ঘনিষ্ঠ সহচর। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা বলছেন, আগামী ২৮ মার্চের জাতীয় সম্মেলনেও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন এটা এক রকম নিশ্চিত।