ঢাকা: অবশেষে গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘ম্যানেজ মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত সাদেক হোসেন খোকা। এবার সরকারকে ‘ম্যানেজ’ করতে ব্যর্থ হওয়ায় খোকা গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে দলীয় পরিমণ্ডলে জোর আলোচনা চলছে। এছাড়া সরকারের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ থেকে নিস্তার পেতে এবং ঢাকা মহানগরে আন্দোলন জমাতে না পারায় নিজেই ধরা দিয়েছেন এমন ‘ভিত্তিহীন’ মন্তব্যও করছেন খোকাবিরোধীরা।
প্রসঙ্গত, সর্বদলীয় সরকার গঠনের পর গত বুধবার রাত দশটার দিকে উত্তরার এক বাসা থেকে খোকাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। বৃহস্পতিবার আদালত তার দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
সাদেক হোসেন খোকা বিএনপির ভাইস চেয়ারসম্যান ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক। প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়রও। ‘এক-এগারোর’ সরকার, মহাজোট সরকার এবং নির্বাচনকালীন ‘সর্বদলীয়’ সরকারের আমলে দলের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করলেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন খোকা। সরকারের একটি প্রভাশালী মহলের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে দলীয় পরিমণ্ডলে কথা চালু আছে।
এছাড়া, দলীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, তিনি বিপুল পরিমান অর্থ দিয়ে ওয়ান-ইলেভেনর সময়ও গ্রেপ্তার ঠেকিয়েছেন।
গত মার্চ মাসে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৫৬ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সে সময় খোকাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তবে পরদিনই অন্যদের কারাগারে পাঠানো হলেও ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পান দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও খোকা।
এছাড়া মহাজোট সরকারের শেষ বছরে সরকারবিরোধী বিভিন্ন ‘উত্তপ্ত’ বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন খোকা। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে একাত্মতা, ‘দা-কুড়াল’ নিয়ে প্রতিরোধসহ বিভিন্ন বক্তব্যের কারণে আলোচনায় আসেন তিনি। একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তারের জন্য তার গোপীবাগ ও গুলশানের বাসায় তল্লাশি চালালেও তিনি গ্রেপ্তার হননি। গ্রেপ্তার এড়াতে একধিকবার মাসাধিক সময় আত্মগোপনেও থাকেন তিনি। দলের কঠোর আন্দোলনে রাজপথে না থাকলেও আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে সমাবেশে যোগ দেন। রাজপথে না থাকায় তাকে শো’কজও করেন দলের হাইকমান্ড।
এদিকে একই সময়ে দলের একাধিক শীর্ষ নেতা এমনকি আত্মগোপনে থাকা নেতারাও গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। দলের সিনিয়র নেতারা গ্রেপ্তার হলেও খোকা গ্রেপ্তার না হওয়ায় সরকারকে ম্যানেজ ও আঁতাতের অভিযোগ ওঠে দলীয় পরিমণ্ডলে।
তবে এবার খোকার গ্রেপ্তারের বিষয়টিকে বাঁকা চোখে দেখছেন খোকাবিরোধীরা। তারা মনে করছেন, এবার সরকারকে ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগরের খোকাবিরোধী এক নেতা জানান, গত ২৫ অক্টোবরের সমাবেশ থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। সারাদেশে এই আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে তীব্র রূপ নিয়েছে। কিন্তু রাজধানীতে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে রাজপথ দখল তো দূরের কথা নেতাদের টিকির দেখাও মেলা ভার। এখন শেষ সমায়ে রাজধানীতে আন্দোলন জমিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে হবে, তা না করে নিরাপদে থাকতে খোকা নিজেই ধরা দিয়েছেন।
জানা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা বাম রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের পর খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের সময়ে মহানগর বিএনপির সভাপতির পদ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমাণ্ডার লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলী পদত্যাগ করলে খোকাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তারপর থেকেই ওয়ান-ইলেভেন পর্যন্ত টানা মহানগর বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
জানা যায়, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ঢাকার মেয়রের পাশাপাশি এমপি নির্বাচিত হন। মহানগর সভাপতি ও ঢাকার মেয়র হওয়ার পর খুলে যায় তার উন্নতির দুয়ার। ওই সময় তিনি পরিচত হন ‘মিস্টার পারসেন্টেজ’ হিসাবে। তখন ডিসিসির কমিশনারদের মধ্যে নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করেন।
২০০৭ সালে আসে বিতর্কিত ওয়ান-ইলেভেন। চারদিকে সংস্কারের রব ওঠে। দলের সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব খর্ব করার পক্ষেও দাঁড়ান তিনি। তবে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভোল পাল্টান। খালেদা জিয়া ও তারেকে রহমানের পাশাপাশি আব্বাস, গয়েশ্বর ছাড়া স্থায়ী কমিটির সব নেতাকেই খোকা ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়েছেন। হয়েছেন খালেদা জিয়ার সবচেয়ে আস্থাভাজনদের একজনও।
দলের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি সবকিছুই ম্যানেজ করতে পারেন। বিতর্কিত এক-এগারোর পরে দলের দুর্দিনে ‘সংস্কারপন্থি’ ভূমিকা নেয়ার পরও খালেদা জিয়াকে ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়েছেন। অসংখ্য বিতর্কের পরেও শুধু ‘ম্যানেজ’ প্রতিভার কারণেই খালেদা জিয়া তাকে আহবায়কের দায়িত্ব দিতে বাধ্য হয়েছেন। এক-এগারোর সরকার ও মহাজোট সরকারকে ম্যানেজ করে গ্রেপ্তার ঠেকিয়েছেন। তবে এবার ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে।