ঢাকা: নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
ফোরামের বেশিরভাগ সদস্য বার্ধক্যজনিত রোগ-ব্যাধি-জরায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। চার বছর আগে মৃত্যু হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য’র। দুর্নীতি-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন দুইজন; গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে আছেন বেশ কয়েকজন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কাঁধে নিয়ে কারাযাপন করছেন একজন।
অর্থাৎ জরা-মৃত্যু-ধরা’য় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি। ১৯ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটির কাছ থেকে সে রকম কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষায় একাই লড়াই করে যাচ্ছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কিছু সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি আমরা মোকাবেলা করছি। সে কারণে হয়তো সবাই মিলে এক জায়গায় বসতে পারছি না। তবে যার যার জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছি।
সূত্রমতে, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট স্থায়ী কমিটিকে ১৯ সদস্য বিশিষ্ট করা হয়।
এই ১৯ জনের মধ্যে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন পদাধিকার বলে স্থায়ী কমিটির সদস্য হন। বাকি ১৬ জনকে নিয়োগ দেন খালেদা জিয়া।
সাধারণত দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হিসেবে জাতীয় স্থায়ী কমিটি-ই বিএনপির সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। যে কোনো ব্যাপারে এই কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সংকটকালে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নেন চেয়ারপারসন।
কিন্তু ৩ জানুয়ারি থেকে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরুর প্রথম দিকে দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য খালেদা জিয়ার কাছে নিয়মিত আসা-যাওয়া করলেও এখন আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রাজপথ তো দূরের কথা- সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমন কি পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্যও বের হচ্ছেন না তারা। গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে খালেদা জিয়া একাই চালিয়ে যাচ্ছেন টানা আন্দোলন।
সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে খালেদা জিয়া সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখতেন প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ওপর। বার্ধক্যজনিত রোগে ২০১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি মারা গেলে অনেকটা একা হয়ে পড়েন খালেদা। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের জায়গায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দায়িত্ব দেন। হরতাল-অবরোধে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন তিনি কাশিমপুর কারাগারে।
স্থায়ী কমিটির তিন নম্বর সদস্য ড. আর এ গণি। থাকেন রাজধানীর ধানমন্ডির ১৯ নম্বর সড়কের ৮২৩ নম্বর বাসায়। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত বর্ষীয়াণ এই রাজনীতিবিদ পারতপক্ষে বাসা থেকে বের হন না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষক ড. আর এ গণিকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিলো গত ২৯ জানুয়ারি। ওই দিন রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করতে হরতালের মধ্যেই গাড়ি ‘হাঁকিয়ে’ গুলশান কার্যালয়ে আসেন তিনি। এর পর আর দেখা মেলেনি তার। মোবাইল ফোনটাও বন্ধ।
স্থায়ী কমিটির ৪ নম্বর সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন আছেন কাশিমপুর কারাগারে। দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় গত বছর ১২ মার্চ গুলশানের নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির ৫ নম্বর সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ গুলশান অ্যাভিনিউ’র ১৫৯ নম্বর বাসায় থাকলেও খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ধারের কাছ দিয়ে হাঁটছেন না। মিডিয়ার সঙ্গে কথাবার্তা বলাও টোটালি বন্ধ করে দিয়েছেন।
দেশবরেণ্য এই রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে খোদ বিএনপি নেতারা অভিযোগ তুলছেন, বাড়ি ‘রক্ষায়’ সরকারের সঙ্গে আপোস করেছেন তিনি। এ কারণে চুপ করে আছেন।
স্থায়ী কমিটির ৬ নম্বর সদস্য এম শামছুল ইসলাম ভুগছেন বার্ধক্যজনিত রোগে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই সদস্য গুলশান কার্যালয় থেকে সামান্য দূরে বারিধারার ৮ নম্বর সড়কের ২ নম্বর বাড়িতে থাকলেও অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়ার কাছে যেতে পারেন না।
স্থায়ী কমিটির ৭ নম্বর সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানই কেবল দলীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা রাজনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক ও জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করছেন। খোলা রেখেছেন নিজের মোবাইল ফোন।
এদিকে আন্দোলনের শুরুতেই স্থায়ী কমিটির ৮ নম্বর সদস্য তরিকুল ইসলাম চলে গেছেন আত্মগোপনে। বন্ধ রেখেছেন মোবাইল ফোন। অতীতে আন্দোলন কর্মসূচির সময় নিজ এলাকায় বিএনপির এই নীতিনির্ধারক সরব থাকলেও এবার তার খোঁজও মিলছে না। বিষয়টিকে কেউ কেউ রহস্যজনক বললেও অন্যরা বলছেন বয়স ও বার্ধক্যজনিত কারণে নিজেকে ঝামেলা থেকে সরিয়ে রেখেছেন বর্ষীয়াণ এই রাজনীতিবিদ।
স্থায়ী কমিটির ৯ নম্বর সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ’র অবস্থান রহস্যজনক বলছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। আন্দোলনের শুরুতে সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালামীয় বক্তব্য দিলেও এখন তিনি নীরব। মহাখালীর ডিওএইচএস’র বাসা থেকে একদম নড়ছেন না তিনি।
এদিকে স্থায়ী কমিটির ১০ নম্বর সদস্য এমকে আনোয়ার তার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়-ই অবস্থান করছেন। আন্দোলনের শুরুর দিকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে আসা-যাওয়া করলেও এখন তার দেখা মিলছে না। সাবেক এই আমলাও শারীরিকভাবে ফিট নন। আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি তাকে আরো অসুস্থ করে দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নীতিনির্ধারণী ফোরামের ১১তম সদস্য বেগম সারোয়ারী রহমান শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। গুলশান ২ নম্বর সেক্টরের ৫১ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িতে বসবাস করছেন তিনি। তারপরও খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে আসতে পারছেন না।
স্থায়ী কমিটির ১২ নম্বর সদস্য সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ১৩ নম্বর সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান যথারীতি চুপচাপ। কূটনীতিকদের পেছনে ঘোরাঘুরিতে ড. আব্দুল মঈন খানকে কিছুটা সরব দেখালেও জমির উদ্দিন সরকার একেবারেই নীরব। ধানমন্ডির বাসা এবং নিজের চেম্বার ছাড়া কোথাও যাচ্ছেন না তিনি।
সময়ের প্রেক্ষাপটে স্থায়ী কমিটির সবচেয়ে আলোচিত সদস্য মির্জা আব্বাসের অবস্থান নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হচ্ছে বিএনপিতে। সাদেক হোসেন খোকার জায়াগায় তাকে বসিয়ে ঢাকা মহানগর থেকে যে আন্দোলন আশা করেছিলো তার দল তিনি তার ছিঁটেফোটাও দিতে পারেননি। বরং আন্দোলনের শুরুতেই হারিয়ে গেছেন মির্জা আব্বাস।
আন্দোলনের ডাক পড়লে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির রেওয়াজ এবারও ঠিক রেখেছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির ১৫তম সদস্য নজরুল ইসলাম খান। কিন্তু ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে ঢুকে আর বের হতে পারেননি তিনি। এখনো গুলশান কার্যালয়ে আছেন বিএনপির এই নীতিনির্ধারক।
নিজ দলের ছিদ্রান্বেষণে সদা ব্যস্ত স্থায়ী কমিটির ১৬ নম্বর সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আন্দোলনের শুরুতেই পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছেন। এখন আছেন কাশিমপুর কারাগারে।
দলের আইন-আদালতের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করা স্থায়ী কমিটির ১৭ নম্বর সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া নিজের বাসা ও সুপ্রিমকোর্টে ঘোরাঘুরি করেই দিন পার করছেন। আন্দোলনের শুরুতে গুলশান কার্যালয়ে কয়েক দফা এলেও এখন আর এদিকে আসছেন না।
স্থায়ী কমিটির ১৮ নম্বর সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি রয়েছেন। বিএনপির প্রভাবশালী এই নেতার অবর্তমানে তার শক্ত কয়েকজন প্রতিনিধি বিএনপির কর্মসূচিতে সরব রয়েছেন বলে জানা গেছে।
স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ, সর্ব কনিষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবস্থান করছেন লন্ডনে। সেখান থেকেই বিএনপি চালান তিনি। তবে উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিয়ে সরকার, সাধারণ মানুষ এবং বিএনপির বড় একটি অংশের বিরাগভাজন হওয়া তারেক রহমানের কোনো বক্তব্য মিডিয়ায় না আসায় তাকেও এখন নিষ্ক্রিয় নেতা হিসেবে মনে করছেন সবাই।