রাজপথে সক্রিয় আন্দোলনে না থাকলেও নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন করে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা সাজাচ্ছে বিএনপি। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছরের মার্চের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের আশা করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। তাদের মতে, খুব শিগগিরই দুঃসময় কেটে যাবে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ-নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। দেশে গণতন্ত্র ফিরবে। এখন শুধু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা।
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মধ্যস্থতা ও সংলাপের ওপর আপাতত বেশি জোর দিচ্ছে বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের শীর্ষ নেতারাও বারবার তাই সংলাপের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। জানা গেছে, বিএনপি একটি প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে একটি নতুন নির্বাচন আদায়ের বিষয়ে পর্দার অন্তরালে আলোচনা চালাচ্ছে। সেই দেশের প্রতিনিধিরা ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। রাজনৈতিক সহঅবস্থান নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। অপর একটি সূত্র জানায়, নতুন জাতীয় নির্বাচন আদায়ে বিদেশি রাষ্ট্রের পরামর্শে বিএনপি ইসলামী দলগুলোর সঙ্গ ছাড়তেও প্রস্তুত বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, প্রাথমিক আলোচনার ভিত্তিতেই বিএনপির কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের জামিন ও রাজধানীতে সমাবেশ করার সুযোগ দিয়েছে সরকার।
দুই বছরের বেশি সময় কারাভোগের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গত বুধবার জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। জামিন মিলেছে ওপর স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ারেরও। দু’একদিনের মধ্যে তিনিও মুক্তি পাবেন। এর আগে দীর্ঘদিন কারাভোগের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদসহ বেশ কয়েক শীর্ষ নেতা জামিনে মুক্তি পান। এ ছাড়া ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের দুই বছর পূর্তিতে বিএনপি রাজধানীর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এটাই বিএনপির প্রথম সমাবেশ। ইতিপূর্বে একাধিকবার সমাবেশ করতে চাইলেও বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে অনুমতি দেয়া হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের মানুষের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশ্বও বাংলাদেশে নতুন নির্বাচন চায়। বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। তারাও আমাদের যুক্তি মানছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহাবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম করছে। এ মুহূর্তে রাজপথে কর্মসূচি না থাকলেও আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি, গণতন্ত্র ও নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা আমাদের দলের পক্ষ থেকে জনগণের পাশাপাশি বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরা হচ্ছে। তিনি বলেন, একই সঙ্গে আমাদের দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার কাজও চলছে। পুনর্গঠন শেষ হলেই জনগণের দাবি আদায়ে বিএনপি আবারো রাজপথে নামবে। বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের মার্চের আগেই বিএনপি তার ষষ্ঠ কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। যোগ্য, ত্যাগী ও ঝুঁকির মধ্যেও যারা কাজ করতে পারবে তাদের কাঁধেই দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হবে। জানা গেছে, বিএনপি পুনর্গঠনে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের প্রাধান্য দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও বিএনপি এখনো দলের কাউন্সিল করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় ঘোষণা করেনি। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, আমাদের দলের কাউন্সিল করার বিষয়ে নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। তবে এখনো চূড়ান্তভাবে সময় নির্ধারণ হয়নি।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার তিন বছরে পা দিয়েছে। আর নির্বাচন বয়কটকারী বিএনপি গত দুই বছর ধরে নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেয়ার দাবি করলেও রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। বিএনপির আন্তর্জাতিক মিত্ররা সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পক্ষে থাকলেও তারা দৃশ্যত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেনি। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার বিএনপির নানা উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কাজে আসছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছর পূর্তিতে গত বছর জানুয়ারি থেকেই রাজপথে লাগাতার হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে সক্রিয় ছিল বিএনপি ও তার জোটের শরিকরা। সে সময়ের দুই মাসেরও বেশি সময়ের আন্দোলনে সফলতা আসেনি। বরং মামলার জালে বন্দি হয়ে পড়েছে দলটির অধিকাংশ সক্রিয় নেতাকর্মী। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সব পর্যায়ের নেতাকর্মী শত শত মামলা মোকাবিলা করছেন। এক পর্যায়ে আন্দোলন বন্ধ করতে বাধ্য হয় বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতারা সংগঠন পুনর্গঠনের ঘোষণা দেন। ফলে সরকারের দ্বিতীয় বছর পূর্তিতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানানো ছাড়া কোনো কর্মসূচিই দিতে পারেননি। রাজনৈতিক বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেই গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর সারাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। শুরু থেকে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে বিএনপি নানা অভিযোগ, অনিয়মের কথা তুলে ধরলেও নির্বাচন বয়কট করেনি। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়। জানা গেছে, পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল সন্তোষজনক না হলেও সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও অংশ নেবে বিএনপি। বিএনপি নেতারা মনে করেন, পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল বিপর্যয় হলেও রাজনৈতিকভাবে দলের অনেক লাভ হয়েছে। বিশেষ করে ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীরা নির্বাচনকে সামনে রেখে সক্রিয় হয়েছে। নেতাকর্মীদের সেই উদ্যম ধরে রেখে দল পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিএনপি নতুন জাতীয় নির্বাচন আদায়ে এপ্রিলের পর থেকে রাজপথেও প্রথম ধাপের কর্মসূচি দেবে। মানবকণ্ঠ