শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। একটি জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। একজন মানুষের মেরুদণ্ডের হাড়যত বেশি মজবুত হয় এবং এর গড়ন যত বেশি টিকসই সে ব্যক্তি তত বেশি সোজা হয়ে দাড়াতে পারে তেমনি যে জাতির লোকেরাজ্ঞানের রাজ্যে যত বেশি বিচরণ করবে সে জাতি তত বেশি গৌরব এবং মর্যাদার অধিকারী হবে। প্রাচীন যুগের গ্রীকরা এর প্রকৃতউদাহরণ। কেবল সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল কিংবা মহাবীর আলেকজান্ডার গ্রিকদের মধ্য থেকে ব্যক্তি কেন্দ্রিক শিক্ষিত ছিল নাবরং তাদের সকলেই কম বেশি জ্ঞানের চর্চা করত। তাইতো কয়েক হাজার বছর পূর্বের সে মানুষগুলোর রচনাবলীর মধ্যে আজওমানুষ রাষ্ট্রের কল্যাণ, রাষ্ট্রের আদর্শ, নীতি তত্ত্বের আলোচনা খুঁজে সে অনুযায়ী রাষ্ট্র এবং জীবন গঠন করতে চায়। বিশ্বেরদরবারের যতগুলো জাতি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব পেয়েছে তার সবগুলো জাতিই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে বিশ্ববাসীর কাছে তাদের জাতচিনিয়েছে। সকল যুগেই কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছিল, আছে এবং আজীবন থাকবে। তিক্ত হলেও সত্য যে, সে ব্যতিক্রমীদের মধ্যেবাঙালীরা অর্থাৎ আমরাও শামিল হয়েছি। যে কোন জাতি দু’ভাবে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পেতে পারে। আর তা হলো, হয় সাধু হওনয় চোর হও। কিন্তু আমরা অলস বাঙালীরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সমগতিতে চলছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রবণতা। যে কোনপাবলিক পরীক্ষা শুরু হলেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথাটি যেন পরিপূরক হিসেবে চলে আসে। অর্থাৎ পাবলিক পরীক্ষা হবে আর প্রশ্নপত্রফাঁস হবে না এটা কি করে হয়! তাই নিয়মিত পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। বাজারের আলু পটলের মত সব স্থানেই প্রশ্নপাওয়া যায়। হঠাৎ করে পরীক্ষার আগের রাতে শোন যায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে। আর চোরাকারবারীরা চড়াদামে সেই প্রশ্নবিক্রি করে তাদের ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে উঠছে। পিএসসি থেকে শুরু করে বিশ্বদ্যিালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পরীক্ষার আগেই ফাঁসহয়ে যাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে চোরাকারবারীদের পাশাপাশি স্থান দখল করেছে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম। শিক্ষার্থীদেরঅভিভাবকেরা একদিকে তাদের সন্তানকে পড়তে দিয়ে শিক্ষার প্রতিযোগিতার জন্য অন্যদিকে ইন্টারনেটে খোঁজতে থাকে কোন প্রশ্নফাঁস হয়েছে কিনা, আর যদি ফাঁস হয়েই থাকে তাহলে কিভাবে তা পাওয়া যাবে। অবশ্য আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মনে এখনোজ্ঞান অন্বেষণের মানসিকতা ব্যাপক স্থান জুড়ে আছে। তবে অনৈতিকতার রাজ্যে নৈতিকতা কয়দিন টেকে? প্রকৃত শিক্ষার্থীরা যখননৈতিক ভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সারা বছর ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে কাটানো, হাজিরা খাতার সর্বশেষ অবস্থানের ছেলেটিরচেয়ে ফলাফলে পিছিয়ে পরবে তখন নৈতিকতা নামক বিরল বস্তুটি পালানোর রাস্তা পাবে কি? কাজেই শিক্ষার হার বাড়াতে গিয়েনকল প্রথা এবং প্রশ্নপত্রের ফাঁসের মাধ্যমে জাতিকে মেরুদণ্ডহীন করে দেওয়া হচ্ছে নাতো? তা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। ভঙ্গুরমেরুদণ্ড নিয়ে যে জাতি বেঁচে থাকে সে জাতি সমাজের কোন উপকারে তো আসেই না বরং সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাড়ায়।অন্যদিকে, সরকার ও তার শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষার ব্যাপারে তাদের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে আছে।এক সেট প্রশ্নের নিরাপত্তা দিতেতারা ব্যর্থ।শুধু তাই নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি স্বীকার করতেও অস্বীকৃতি জানায়। প্রত্যেকটি পরীক্ষারপ্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায় আর সেটি নিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয় তাদের বিন্দুমাত্র দায়িত্ববোধ নেই। গত কয়েক বছরে প্রশ্নপত্র ফাঁসেরঘটনা, ঘটনার প্রকৃতি, বিভিন্ন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ইত্যাদি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ ঘটনায় বিজি প্রেসেরএকশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রাথমিকভাবে জড়িত। প্রশ্ন বাজারজাত করে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার। দু-একটি ক্ষেত্রে পরীক্ষা-সংশ্লিষ্টপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে কেন যেন মনে হয়, আমাদের দেশের সবকিছু এখনপ্রধানমন্ত্রী-কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। শুভ ও অশুভর মাঝখানে তিনিই আমাদের সর্বোচ্চ আশার প্রতীক। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর জন্যওকি আমরা প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হব? আর সব যদি প্রধানমন্ত্রীকে একাই সামলাতে হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের ভূমিকাকতখানি? মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা সবার জন্যই খুব অস্বস্তিকর। এবার যারামেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবে তারা ভাল-মন্দ যাই হোক, দীর্ঘকাল এই কালিমা তাদের বয়ে বেড়াতে হবে। সময় এবং প্রশাসনেরবর্তমান যে মনোভাব এবং আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের যে সংখ্যা, তাতে মনে হয় না এবছর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি প্রতিহতকরা যাবে। ওয়াজ, উপদেশ কিংবা অনুরোধ করে নৈতিকতা জাগ্রত করা যায় না। প্রত্যেকের বিবেকের জবাবদিহিতা জাগ্রত হওয়াচাই । নীতি কথা দিয়ে যাদের সৎপথে আনা সম্ভব নয় তাদের জন্য বেতের লাঠি এবং শ্রীঘরই উত্তম । মাত্র হাতে গোন কয়েকজনব্যক্তি প্রশ্নপত্র ফাঁস করার ক্ষমতা রাখে । তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে এর নিস্তার সম্ভব হবে ।
অতীতেরসে সকল রিপোর্টের বিশ্লেষণ এবং বর্তমান কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোকে ফাইল বন্দী না রেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাআবশ্যক । শিক্ষা সংক্রান্ত এ অপতৎপড়াতাকে মাথাচাড়া দিয়ে জাগতে দিলে পরবর্তী প্রজন্ম পঙ্গুত্ব বরণ করবে । একেকজনঅনেকগুলো শিক্ষা সনদপত্রের অধিকারী হবে ঠিকই তবে চিরকাল লাঞ্ছনা, গঞ্জনা নিয়ে বাঁচতে হবে । কাজেই পাবলিক পরীক্ষাসমূহ(অপরাধ ) আইন ১৯৮০ এবং এর সংশোধনী ১৯৯২ সালের আইনে যে শাস্তির বিধান রয়েছে (প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণেরসাথে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড) তাকে আরও বাস্তমূখী করে প্রয়োগ করতেহবে । আগামীতে দেশকে একটি দক্ষ জাতি উপহার দিতে হলে শিক্ষা সংক্রান্ত সকল অপরাধের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোরআইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ হাতে নেয়া জরুরী । তা না হলে সভ্য একটি জাতি আবারও অসভ্য এবং প্রকৃত মূর্খ জাতিতে পরিণতহবে। সরকার, শিক্ষামন্ত্রী এবং শিক্ষা সংক্রান্ত সকল কর্মকর্তা, কর্মচারীরা নিশ্চয়ই এটা চাইবেন না।