দেশের গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যম এ দুই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এ দুইয়ের মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ দেখা দিলে তা হবে গোটা জাতির জন্য অশনিসংকেত। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক সীমারেখা ও শ্রদ্ধার ওপর গুরুত্ব দিয়ে যেমন নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে, তেমনি যে কারোর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সামালও দিতে হবে দেশ ও সাধারণ মানুষের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় রেখেই। কারণ স্বাধীন বিচার বিভাগ ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম- এ দুই-ই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। এ দুই প্রতিষ্ঠান একে অন্যের রক্ষাকবচ। আমাদের সংবিধান ৩৯(২)(খ) অনুচ্ছেদে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দিয়েছে তা কিন্তু রক্ষার দায়িত্বও দিয়েছে সংবিধানের ৪৪ ও ১০২ অনুচ্ছেদে আমাদের সুপ্রিম কোর্টকেই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চিরায়ত তত্ত্বে রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান স্তম্ভে বিচার বিভাগের অবস্থান অন্যতম হলেও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন গণমাধ্যম। আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অন্তরালে যেমন গণমাধ্যমের সাহসী ভূমিকা রয়েছে, তেমনি যুগে যুগে এ দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্যও লড়াই করেছে আমাদের গণমাধ্যমই। দেশের অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিক এ জন্য কারাবরণ করেছেন। হত্যা, হামলা, মামলার শিকারও হয়েছেন এ দেশের নির্ভীক সাংবাদিকরা। তবে আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অজুহাতে যা খুশি তা করতে পারার গ্যারান্টিটা কিন্তু দেওয়া হয়নি। সাংবাদিক নেতারা কিংবা আইনজীবী নেতারা প্রকাশ্যে অনেক কথাই বলতে পারেন। কিন্তু আমাদের বিচারকদের সে সুযোগটুকু একেবারেই নেই। তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয় সম্পূর্ণ নির্মোহ ও পক্ষপাতহীনভাবে। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে পল্টনীয় কায়দায় বক্তব্য প্রদান যেমন গর্হিত কাজ, তেমনি পুরো সাংবাদিক সমাজকে কটাক্ষ ও হেয়প্রতিপন্ন করাও শোভনীয় হতে পারে না কখনো। আদালত কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয় যে তার বিরুদ্ধাচরণ বৈধতা পাবে। আদালতের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক কর্তব্য। কোনো ব্যক্তিবিশেষের আদালতের প্রতি আস্থায় ঘাটতি থাকতেই পারে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসটুকু যেন সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর আস্থাহীনতার সুযোগ উসকে না দেয় কখনো। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যত গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন আমরা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নই। অপরাধের বিচার ব্যক্তির বিরুদ্ধে হয়। কোনো পেশায় নিযুক্ত সবার বিরুদ্ধে নয়। আবার ব্যক্তির অপরাধে সংশ্লিষ্ট পেশার সবাইকে ঢালাওভাবে অবমাননা করাও মারাত্দক অপরাধ। সাম্প্রতিক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আদালত অবমাননার বিচারিক প্রক্রিয়ায় শুনানি চলাকালেই যেভাবে আদালতের বিষয়ে বিবৃতি-প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে তাতে রাষ্ট্রের প্রধান দুটি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আমাদের সবাইকে আদালতের রায়ের প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল হতে হবে তেমনি রায় প্রদানের আগে কোনো অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির পথ রুদ্ধ করতে হবে। কেননা দেশের সর্বোচ্চ আদালত ১৯৯৩ সালের সলিম উল্লাহ মামলায় আদালতের বিরুদ্ধে সমালোচনাকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার স্বার্থে নিষিদ্ধ করেননি। তবে এ স্বাধীনতা অবশ্যই আদালতের প্রতি অবমাননাকর হতে পারে না। আদালতের বিরুদ্ধে সমালোচনা আর আদালত অবমাননা কখনো এক ও অভিন্ন নয়। আদালত অবমাননার শুনানির সুযোগে সাংবাদিকদের সততা নিয়ে ঢালাওভাবে পুরো সংবাদমাধ্যমকে হেয়প্রতিপন্ন করাটাও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগকে মুখোমুখি করার অপচেষ্টাকারীরাও আদালত অবমাননাকারী।
আমাদের বিচার বিভাগ ও উচ্চ আদালতের সম্মানিত বিচারকদের নিয়ে বিভিন্ন সময় অবমাননাকর মন্তব্য যেমন আমাদের চোখে পড়েছে, তেমনি আদালত অবমাননায় দেশি-বিদেশি একাধিক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রুল জারিও হয়েছে। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রীও এর বাইরে থাকতে পারেননি। পত্রিকার সম্পাদকও আদালত অবমাননায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জেল খেটেছেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশে এখন আদালত অবমাননার কোনো আইনই নেই। ১৯২৬ সালের একটি আইন ছিল কিন্তু তাও বছরকয়েক আগে হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছেন। তবে আদালত অবমাননার শুনানি ও বিচার করার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা হাইকোর্টের রয়েছে। আমরা আশা করছি এ ধরনের মামলার রায়ে আদালত অবমাননার আইনের উৎকর্ষতা আরও বৃদ্ধি পাবে। আইন না থাকা অবস্থায়ও অপরাধের ধরন, সংজ্ঞা, পরিধি, প্রয়োগ, প্রক্রিয়া, শাস্তি প্রভৃতি বিষয়ে আদালতের রায়ে একটি আইনি গাইডলাইন থাকবে বলে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করি।
আইনি দুর্বলতার সুযোগে বারবার আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের বিচার বিভাগ। এর আগেও আমরা লক্ষ্য করেছি বিগত নবম জাতীয় সংসদের ১৪তম অধিবেশন শুরুর দিন জ্যেষ্ঠ এমপিদের কেউ কেউ সুপ্রিম কোর্টের সম্মানিত কয়েকজন বিচারপতির নাম নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। এমনকি বিচারপতিদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে এহেন ব্যক্তিগত আক্রমণ বন্ধে তখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার প্রধান বিচারপতির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল বলে তখনকার সংসদের স্পিকার রুলিং পর্যন্ত দিয়েছিলেন। এরপর একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্পিকারের এ রুলিংকে ‘অকার্যকর’ বলে আদেশ দেন। আমাদের সংবিধানের অভিভাবক হলো সুপ্রিম কোর্ট। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অভিভাবকও সুপ্রিম কোর্ট। আবার বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী হলো গণমাধ্যম। তাই দুটো প্রতিষ্ঠান একে অন্যের প্রতিপক্ষ নয় বরং পরিপূরক। আর তার সুবিধাভোগী হলো দেশের ১৬ কোটি মানুষ। অহেতুক সংঘাত সৃষ্টি করে গণমানুষের অধিকারের প্রতীক এ দুই প্রতিষ্ঠানকে মুখোমুখি অবস্থানে কারা আনতে চাইছে তা অবশ্যই উদঘাটন করা প্রযোজন। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল স্বাধীন বিচার বিভাগ আমাদের যেমন প্রয়োজন তেমনি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতীক স্বাধীন সংবাদমাধ্যমও সমান প্রয়োজন। একটিকে ক্ষুণ্ন করে আরেকটির প্রাপ্তি কখনো অর্থবহ হয় না। আমাদের দুটোই প্রয়োজন। এক চোখ ক্ষতিগ্রস্ত করে অন্য চোখ রক্ষা করতে আমরা চাই না। আমাদের দুটো চোখই দরকার। সে দুই চোখেই আমরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে দেখতে চাই। লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com