[ads1]তদানীন্তন পাকিস্তানের দুই প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেসামরিক ও সামরিক চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য, শিল্পায়ন ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে সরকার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে মরহুম এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরী সরকারদলীয় সংসদ সদস্য হয়েও হুঁশিয়ারি দেন যে, আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের ব্যর্থতা দেশের অখণ্ডতাকে হুমকির সম্মুখীন করবে। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের প্রশ্নে যথোপযুক্ত ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ে আমরা জাতীয় পরিষদের, অর্থাৎ পার্লামেন্টের কার্যবিবরণী থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে ফজলুল কাদের চৌধুরী তথ্যাদি উপস্থাপন করে যুক্তিতর্কের অবতারণা করে ছিলেন। তারিখ ছিল : ১৫.১২.১৯৬৬ ইং। আমরা কয়েকটি উদ্ধৃতি প্রদান করছি :[ads2]
01. Thank you Mr. speaker for allowing me the floor. You know, sir, since independence East Pakistan, where major part of the population lives agreed to a parity of representation in the legislature. This concession by East Pakistan is unique in history. In the interest of amity, majority population of Pakistan, who live in East Pakistan surrendered their status and agreed to have parity with their brethren living in West Pakistan. But sir, in spite of such sacrifice on the part of East Pakistan parity in financial allocations, in appointments, in services between the two wings have not yet been achieved. Since Independence, want of parity in government development programmed and in services always agitated the minds of East Pakistan. Mr. Speaker sir, if one goes into the record of the proceedings of the legislature of Pakistan, one would find that day in and day-out East Pakistan had been crying hoarse demanding parity in all spheres of government activities.
Every time East Pakistanis were told that attempts were being made for bringing about parity. But with what result? Gross disparity continues even now between the two wings in every sphere. We had been told that after the promulgation of 1962 constitution, removal of disparity is a constitutional obligation. Mr. Speaker sir, I will drown your kind attention to the relevant article of the constitution and then it will be clear to every body whether that provision of the constitution had been carried out or not, by the government.[ads2]
অর্থাৎ, স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার আবাস পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় সমানসংখ্যক প্রতিনিধিত্বকে মেনে নেয়। পূর্ব পাকিস্তানিদের দেয়া এই কনসেশান বা সুবিধা প্রদান ইতিহাসে নজিরবিহীন। বন্ধুত্বের স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার স্ট্যাটাসকে বিসর্জন দিয়ে সমতার ভিত্তিতে ভ্রাতৃপ্রতিম পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বাস করতে সম্মত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের এরূপ ত্যাগ সত্ত্বেও অর্থনৈতিক বরাদ্দ ও চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুই প্রদেশের মধ্যে সমতা বজায় রাখা হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এবং চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানিদের মনকে নাড়া দেয়। মাননীয় স্পিকার, কেউ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের কার্যবিবরণী রেকর্ড খতিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন, দিনের পর দিন পূর্ব পাকিস্তানিরা সরকারের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য তীব্র দাবি জানিয়ে আসছে। প্রত্যেকবার পূর্ব পাকিস্তানিদের আশ্বাস দেয়া হয়, বৈষম্য দূরীকরণের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে; কিন্তু ফলাফল কী দাঁড়াচ্ছে? দুই প্রদেশের মধ্যে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিরাট বৈষম্য বিরাজ করছে। ১৯৬২ সালের সংবিধান ঘোষণার পর আমাদের বলা হয়, বৈষম্য দূরীকরণ হচ্ছে একটা সাংবিধানিক দায়িত্ব।
[ads2]তিনি বলেন, এভাবে সরকার বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে সংবিধানকে বারবার লঙ্ঘন করেছে। বর্তমান সরকার কি জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করবেন কেন তারা এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে লঙ্ঘন করলেন? আরো বলেছিলেন, আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্নভাবে প্রতীক্ষা করছি এ ব্যাপারে সরকারের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অনগ্রসর এলাকার জনগণ যদি বৈষম্য দূরীকরণের ব্যাপারে সরকারের বিশ্বস্ততা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ফজলুল কাদের বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের অনুন্নত এলাকাগুলো পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে কম দুর্ভাগা নয়। বেলুচিস্তান, সিন্ধু, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং পাঞ্জাবের অনুন্নত এলাকার অধিবাসীরাও সাংবিধানিক ব্যবস্থায় বৈষম্য দূরীকরণের আশায় আছে। এটা অবিশ্বাস্য যে, বৈষম্য দূরীকরণের ব্যাপারে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে না, এটা আমাদের প্রেসিডেন্ট জানেন না।
তিনি আরো বলেন, সশস্ত্র বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানিদের আনুপাতিক হার জানার অধিকার কারো নেই। পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য কত অসহায় অবস্থা। প্রয়োজনে যদি সশস্ত্র বাহিনীর জন্য আরো অর্থ ব্যয় হয়, পশ্চিম পাকিস্তান এটাকে স্বাগত জানাবে; কিন্তু তাদের অবশ্যই জানতে হবে, প্রতিরক্ষা বিভাগে চাকরির ক্ষেত্রে দু’প্রদেশের মধ্যে সমতা বজায় রাখা হচ্ছে কি না। আমি বুঝি না, সশস্ত্র বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানিদের সংখ্যা প্রকাশ না করে কি স্বার্থ সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, জনসংখ্যার ভিত্তিতে সব অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব না থাকলে গণতন্ত্র স্থিতিশীলভাবে কাজ করতে পারে না। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। এটা আজকের দুনিয়ার অভিজ্ঞতা। করাচির পাকিস্তান নেভাল একাডেমিতে ৯৪ জন ক্যাডেটের মধ্যে মাত্র চারজন পূর্ব পাকিস্তানি। এটাই কি তাদের কৃতিত্ব যারা বৈষম্য দূরীকরণে সাংবিধানিক দায়িত্বের কথা বলেন? সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে জনসংখ্যার অনুপাতে পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। এটা নতুন কথা নয়। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর স্কুলে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষিত থাকে। সশস্ত্রবাহিনীর চাকরিতে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে কোটা থাকে নির্দিষ্ট ।
সশস্ত্রবাহিনীতে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়াই পর্যাপ্ত নয়। এ ক্ষেত্রে নিয়োগনীতি পুনর্বিবেচনা করা উচিত, যাতে উভয় প্রদেশের মধ্যে সমতা বজায় থাকে। বৈষম্য দূরীকরণের সাংবিধানিক দায়িত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অন্য কোনো উপায় নেই। আশা করছি, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নজর রাখবেন যে, সংবিধান লঙ্ঘন করা হচ্ছে না।
[ads1]তিনি বলেছিলেন, , Last Indo-Pakistan conflict had shown that East Pakistan must be made self sufficient in every respect and more so in defense. You know sir, during the September conflict East Pakistan was not only cut off completely from West Pakistan but also from the rest of the world. অর্থাৎ- সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধে এটাই প্রমাণ হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানকে সর্বদিক দিয়ে বিশেষ করে প্রতিরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা আবশ্যক। আপনি জানেন, ’৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান শুধু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নয়, সারা বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বহির্বিশ্বের কোনো ডাক যোগাযোগ ছিল না। … আশা করি, সমর বিশারদেরা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করবেন।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, সমতার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগ এবং সম্পদ বণ্টনের দাবি তুললে নির্দিষ্ট মহল থেকে সঙ্কীর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের ধুয়া তোলা হয়; কিন্তু মাননীয় স্পিকার, দু’প্রদেশের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা মানে, সঙ্কীর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ নয়, বরং এটাকে বাস্তববাদ মনে করি। শক্তিশালী হওয়ার জন্য যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য প্রয়োজন তা সমতার ভিত্তিতে হতে হবে।
[ads1]অভিভাষণের দীর্ঘ উদ্ধৃতি এ কারণে দেয়া হলো যে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকারের প্রশ্নে ফজলুল কাদের চৌধুরী জাতীয় পরিষদে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি কখনো ‘ইয়েস বস্’ ছিলেন না। জননেতা হিসেবে সব সময়ে বঞ্চিত জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে সামনে এনেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের দাবিকে সব সময় তুলে ধরেছেন। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।
সামরিক শাসক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের গণতান্ত্রিক রায় হরণ করেছে বারবার। ‘পিন্ডি’ চায়নি যে ‘ঢাকা’ গণতান্ত্রিকভাবে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুক। ফজলুল কাদের সেই ভারসাম্যহীন একদেশদর্শিতার অবসান চেয়েছেন এবং সে ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
আমরা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেনের একটি মোক্ষম উক্তির শরণ নিচ্ছি, ‘ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সময়কালের ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে, যেখানে অতীত ঘটনা বিচারে ভিন্ন ভিন্ন পথ ও পদ্ধতি থাকতে পারে এবং সেখানে যদি মতভিন্নতাও থাকে, সে ক্ষেত্রে যৌক্তিক পরিণতি অর্জনের বিন্দু আমরা খুঁজে বের করতে পারব। প্রচলিত মতের বিরোধ খুবই জরুরি, কারণ ইতিহাস উপলব্ধিতে বিবিধমুখী প্রণোদনার প্রয়োজন পড়ে। অধিকন্তু কোনো সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনার বেলায় কখনো প্রচলিত মতের বিরোধই হয়ে ওঠে সবচেয়ে আকর্ষণের বিন্দু। তাই উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই গভীরভাবে ইতিহাস নিরীক্ষণে আমার বিশ্বাস।’
[ads1]জাতীয় নেতা হিসাবে ফজলুল কাদের চৌধুরী যেমন ছিলেন দূরদর্শী, তেমনি ছিলেন উদার ও মুক্তিবুদ্ধি সম্পন্ন। জাতীয় নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির সার্বিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তিনি তুলে ধরেছেন। কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের একটি উক্তি স্মরণীয়, ‘বর্তমান অতীতেরই জঠর-প্রসূত ও তার সঠিক যাত্রাপথ- নির্দেশের জন্য কি সুদূর, কি নিকট- দুই অতীতের দিকেই তাকানো ছাড়া উপায় নেই।’
সূত্রঃ নয়া দিগন্ত