কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হানাহানি আর নানা মেরুকরণ চলে আসছে। গেল বছরের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ‘রাজনীতিতে জোর যার ক্ষমতা তার’ বলে একটা সাময়িক সমাধান হলেও সঙ্কট কাটেনি, বরং তা অনেক দূর গড়িয়েছে।তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে। জানা নেই, এর সমাধান কোন পথে, তবে এর যে একটা সমাধান অপেক্ষামান তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লক্ষ্যণীয় যে, গেল কয়েক বছরে রাজনীতিতে ধর্ম ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। সবপক্ষ কমবেশি ধর্মকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। বাস্তবে তাদের দ্বারা ধর্মের কল্যাণ কতটুকু হয়েছে তা অবশ্য প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। অন্যেরা এ নিয়ে কী বলবেন জানি না, তবে রাজনীতিতে ধর্ম ব্যাপক আলোচনায় এলেও অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত কিংবা এর কাছাকাছি পৌঁছার মতো কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। এরপরও কেন এনিয়ে এত রাজনীতি?
এটা অবশ্য সবার কাছে পরিষ্কার- রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ধর্মকে টেনে আনার পেছনে মূলতঃ ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই। অবশ্য বর্তমানে শুধু ক্ষমতা নয়, ক্ষমতার দ্বন্দ্বের পাশাপাশি চলছে এক ধরনের আদর্শিক দ্বন্দ্ব। সেটা একদিকে সেক্যুলারিজম, অন্যদিকে তুরস্কের আদলে ইসলামি মূল্যবোধকে ধারণ করে মডারেট সেমি-সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। দ্বন্দ্বটা বেশ জমে উঠেছে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান এবং বেশিরভাগই ইসলামি মূল্যবোধকে ধারণ করে। ফলে আদর্শিকভাবে ক্ষমতাসীনরা সেক্যুলার পলিটিক্সে বিশ্বাসী হলেও তারা কোনো মতেই দেশবাসীকে চটাতে চান না, তাই কৌশলে এগুতে চায়।
আর এজন্যই ক্ষমতাসীনরা সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে ইউরোপ-আমেরিকাসহ দাতা গোষ্ঠীর আস্থা অর্জন ও সমর্থন আদায়ে চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রের সেক্যুলার চরিত্র ক্ষমতাসীনদের কাছে অধিকতর নিরাপদ বলে বিশ্বনেতাদের কাছে প্রতীয়মাণ করতেও তারা বিরোধীদের নিয়ে এক ধরনের তথ্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে অপপ্রচারে মাঠে নামে। তারা প্রমাণের চেষ্টা করে যে, এখানকার রাজনৈতিক বিরোধীরা (বিএনপি-জামায়াত) জঙ্গি কিংবা জঙ্গিবাদের মদতদাতা। এতে ক্ষমতাসীনরা আন্তর্জাতিক মহলকে কিছুটা বোঝাতেও সক্ষম হয়। যার ফলে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রে শত ব্যর্থতা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনদের প্রতি সমর্থন জোগায়। এর প্রমাণও দৃশ্যত হয়।
কিন্তু ক্ষমতাসীনদের এই কৌশল সাম্প্রতিককালে অনেকটাই ব্যুমেরাং। বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব-কর্মতৎপরতা আছে কি নেই, তা নিয়ে চলছে বিতর্ক। আমরা দেখেছি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিছুদিন আগেও আইএস কর্মী আটক এবং তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বেশ ঘটা করে প্রচার করতে। এমপি-মন্ত্রীরাও আইএস নিয়ে কথা বলেন। তারা বাক্যবাণে বিএনপি-জামায়াতকেই আক্রমণ করেন এবং জঙ্গি আখ্যা দিয়ে আইএসের সাথে সম্পর্কিত করার চেষ্টা করেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক ধারাবাহিক ব্লগার হত্যা, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা, তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি সমাবেশে বোমা হামলা, প্রকাশক দীপন হত্যা, অন্য তিনজনের উপর হামলা এবং পুলিশ হত্যার ঘটনায় সরকার বিপাকে। ঘটনার পরপরই আইএস ঘটনার দায় স্বীকার করলেও কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই সরাসরি আইএসের অস্তিত্ব অস্বীকার এবং বিরোধীদের উপর চাপানো হয়েছে।
রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান থেকে মন্ত্রী-এমপি ও দলের নেতারা একযোগে এসব হত্যা ও হামলার জন্য বিএনপি জামায়াতকে দায়ী করেন। যা শুধু দেশবাসীকেই নয়, আন্তর্জাতিক মহলকেও বিস্মিত করেছে। এক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত বর্তমান পরিস্থিতিকে জাতীয় সঙ্কট আখ্যা দিয়ে তা মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যের যে আহ্বান জানিয়েছিল তাও সরকার নাকচ করে দিয়েছে।
এখন সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে দেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও একই সুর মেলাচ্ছে। জঙ্গিবাদ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের অবস্থান এখন বেশ কমপ্লিকেটেড ও দ্বৈত নীতি।
এই উপমহাদেশে কখন থেকে সন্ত্রাসবাদের জন্ম তা জানা নেই, তবে স্বাধীনদেশে সর্বপ্রথম সন্ত্রাসের জন্ম হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমলেই। সে সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে গণবাহিনীর সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার মধ্যদিয়ে সন্ত্রাসের যাত্রা শুরু। সেই সময়কায় থানায় অতর্কিত হামলা, অস্ত্র লুট, প্রকাশ্যে জবাই করে পুলিশ ও মানুষ হত্যা, দিনদুপুরে ব্যাংক লুট, ডাকাতিসহ নানা সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের কথা এখনও ভোলেনি দেশবাসী। অন্যদিকে তৎকালীন বাকশাল সরকারের হাতে সিরাজ সিকদারসহ ৩০ হাজার বাম নেতাকর্মী বিচারবর্হিভূতভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রথম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদেরও জন্ম হয় সেই আমলেই। যদিও আজ তাদের মাঝে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে মধুর সম্পর্ক!
প্রসঙ্গত, ২০০১ সালে টুইনটাওয়ার হামলার পর বিশ্ব ব্যবস্থায় নতুন মোড় নেয়। বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারে সাম্রাজ্যবাদের নতুন কর্মকৌশলে যোগ হয় জঙ্গিবাদ। আর এ জন্য পশ্চিমা মিডিয়ায় ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘জঙ্গিবাদ’ ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ করে ‘আল-কায়দা-লাদেন’ নতুন টার্মে আফগানিস্তান, ইরাক ও পাকিস্তানে এর অস্তিত্ব খুঁজে পেতে কী না করা হয়েছে তা বিশ্ববাসীর জানা।
তবে জঙ্গিবাদ কিংবা সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে বিরোধীদের ভূমিকা একেবোরে ‘দুধে ধোয়া তুলসি পাতা’ নয়। কেননা, ২০০৫ সালে একযোগে দেশের ৬৩টি জেলায় যখন বোমা বিস্ফোরণ ঘটে তখন তারা জঙ্গিবাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’ বলে প্রচার করে। জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর সেই হামলা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ব্যাপক আলোচিত হয়। ওই সময় জঙ্গি হামলায় বিচারক-আইনজীবীসহ ৩৩ জনের মৃত্যু এবং কয়েকশত আহত হন। অবশ্য পরে তৎকালীন সরকারের কঠোর অবস্থানে জেএমবির শীর্ষ নেতাদের বিচারের মুখোমুখি এবং কয়েকজনের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। এতে জঙ্গিবাদ অনেকটাই দমিত হয়।
কিন্তু এর থেকে বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট ও বিরোধী জোটের নেতাদের দ্বারা ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটি আপামর জনসাধারণের কাছে পৌঁছে ‘জঙ্গিবাদ’ লেবেলে। পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ির পর ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবরের রাজপথে আন্দোলনের নামে লগি-বৈঠার জঙ্গিবাদী তাণ্ডব এবং তার ফসল ওয়ান-ইলেভেনের জন্মের কথা তো সবারই জানা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট ক্ষমতাসীন হলে জঙ্গিবাদ শব্দটি আরো বেশি বাণিজ্যিক রূপ পায়। মন্ত্রী-এমপি-নেতারা প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াতের সাথে সম্পর্কিত করে এতো বেশি ব্যবহার করেন যে, সবার কর্ণকুহরে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা হয়। দেশে কিছু ঘটলেই তা ঢালাওভাবে চাপিয়ে দেয়া হয় বিরোধীদের ওপর। যা বর্তমানেও অব্যাহত।
দেশের রাজনীতিতে যখন মূল্যবোধের অবক্ষয়, অগণতান্ত্রিক চর্চা, সমাজে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, ভিন্ন কায়দায় প্রতিপক্ষ তথা ভিন্নমতের লোকদের অবদমিত করার প্রয়াস তখন তদন্ত ছাড়াই রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের এ ধরনের বক্তব্য যেমন নাগরিকদের হতাশ করছে তেমনি আন্তর্জাতিক মহলকেও উদ্বিগ্ন করেছে।
বর্তমানে দেশে এমন এক আতঙ্ক বিরাজ করছে যে, কারো নিরাপত্তা নেই। শুধু লেখকই-প্রকাশকেরাই নয়, হামলার শিকার হচ্ছেন বিদেশিসহ বিভিন্ন পেশার নাগরিকরাও। কোনও ঘটনারই তদন্তে অগ্রগতি নেই। এমন কি, গেল এক সপ্তাহে দুই পুলিশ সদস্যও এর শিকার হয়েছেন। ফলে পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর তা সহজেই অনুমেয়।
অন্যদিকে আইএসের আবিষ্কারের এক বছর যেতে না যেতেই এখন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে দেশ ও সরকার। আইএস নিয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ‘অতি উৎসাহী’ ভূমিকায় বিব্রত সরকার। এইসব ঘটনায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে- এ কথাটি প্রতিদিনই বলা হচ্ছে। দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের নাম বলা হলেও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয় গোপনই থেকে যাচ্ছে। ফলে সরকারের এসব কথা নিজেদের জন্য বুমেরাং হয়েছে।
কেননা, গেল সাত বছর ধরে সরকার বিএনপি জামায়াতকে জঙ্গি আখ্যায়িত করে ব্যাপক প্রচারণা চালালেও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। ফলে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, বিগত দিনে বিএনপি-জামায়াত যে ধরনের সঙ্কটে পড়েছিল তাদের সেই পথের কাঁটা যেন ক্ষমতাসীনরাই সরাতে সিদ্ধহস্ত। এতে বিএনপি-জামায়াত ক্রমেই কাটিয়ে উঠছে ইমেজ সঙ্কট। আর এটাই বাস্তব। কেননা, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইরানে রেজাশাহ্ ও তুরস্কে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কও একই কায়দায় বিরোধীদের দমনে রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। কিন্তু তা তাদের জন্য শুভকর হয়নি। সেখান থেকেও আমাদের রাজনৈতিক নেতারা শিক্ষা নিতে পারেন!
সাম্প্রতিক সময়ের হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যদের বক্তব্যে সবাই উদ্বিগ্ন। কেননা, রাষ্ট্র যে নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে এটা কোনোভাবেই মানতে নারাজ তারা। বরং যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে সংঘটিত খুনের ঘটনা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে এখানকার এসব খুনকে স্বাভাবিক এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের কাজ হিসেবে বলার চেষ্টা করেছেন। তারা বলছেন কেউ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, কেউ জেএমবি, কেউ হরকাতুল জিহাদ, কেউ হুজি নাম দিয়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করছে। এরা সবাই জামায়াত-শিবির ও বিএনপির খণ্ডিত অংশ।
ফলে সরকারের বক্তব্যে এটা সবার মনে বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন না করে বরং তা ব্যবহার করে বিরোধীদের দমনে বেশি সক্রিয়। যা দেশ ও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এ যেন, ‘নিজের পায়ে কুড়াল মেরে অন্যের ক্ষতি করতে সিদ্ধহস্ত, এর মতো দশা!
সহিংসতা ও প্রাণহানি দেশবাসীর কাম্য নয়। ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’র যে স্লোগান ক্ষমতাসীনরা দিচ্ছেন তাও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সাধারণ জনগণ আর হত্যা-নির্যাতনের রাজনীতি দেখতে চায় না। তারা আইনের শাসন দেখতে চায়। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে জঙ্গিরা। তাই চোরাগলি থেকে রাজনীতিকে ফের রাজপথে ফিরিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জনগণকে রাজনীতির ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিতে হবে। তবেই আশা করা যায়- ষড়যন্ত্র বন্ধ হবে, জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তাও সুসংহত হবে। সেই সাথে বিরোধীদেরও সুযোগ এসেছে দেশবাসীর কাছে নিজেদেরকে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক প্রমাণের। তাই তাদের উদ্দেশে বলবো- বিপদে পড় নহে ভয়, অভিজ্ঞতায় হবে জয়।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
ই-মেইল: sarderanis@gmail.com