এই পৃথিবী বিজয়ীর বন্দনা করে, পরাজিতের বিচার করে। হিটলার রাশিয়া আক্রমণ না করলে বা সেখানে না হেরে গেলে, তিনিই হতেন বিশ্বজয়ী। এটিলা দ্য হান, আলেকজান্ডার কিংবা জুলিয়াস সিজারের মতো তার জন্যও হতো বীরবন্দনা৷ ইংরেজির বদলে আমরা হয়তো শিখতাম জার্মান ভাষা। থ্যাঙ্ক ইউ না বলে বলতাম ডাঙ্কেশুন্!
এখনকার বিশ্বে বিজয়ী শক্তি আমেরিকা। না হলে জাপানে পারমাণবিক বোমা মারার জন্য কিংবা লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, ইরাক আর আফগানিস্তানে গণহত্যার জন্য তাদের রাষ্ট্রনায়কদের বিচার হতো আন্তর্জাতিক কোনো আদালতে৷ বিজয়ী বলে তারাই বরং সারা বিশ্বে সবক দিয়ে বেড়ায় মানবাধিকারের। অন্য দেশ লুট করে, সংখ্যালঘুদের নিপাত করে আর নিজের দেশের গরিব মানুষকে জোর করে যুদ্ধে পাঠিয়ে গড়ে ওঠা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ এখন বাদবাকী বিশ্বকে শিক্ষা দেয় রাষ্ট্রীয় নীতিশাস্ত্রের।
এমন এক বিশ্বে অভূতপূর্বভাবে বিজয়ী নরেন্দ্র মোদির বন্দনা বিস্ময়কর নয়। স্বাধীনতার পর ৬৬ বছরের মধ্যে ৩২ বছর সরাসরিভাবে এবং আরও ১০ বছর মনমোহনের মাধ্যমে ভারত শাসন করা নেহরু পরিবার ও কংগ্রেসকে তিনি প্রায় সর্বস্বান্ত করে দিয়েছেন ভারতের সবশেষ নির্বাচনে। গুজরাটের কসাই হিসেবে পাশ্চাত্যে একসময় অবাঞ্ছিত মোদিবন্দনায় তাই শামিল হয়েছে উন্নত-অনুন্নত সব বিশ্ব। মোদি সাম্প্রদায়িক, মোদি নারীবিমুখ, মোদি অভিবাসীবিরোধী, মোদি নির্মম। সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে মোদির বিজয়। মোদি এককভাবে সারা ভারতে উড়িয়েছেন বিজেপির বিজয় পতাকা। জয়ের পরও চলছে তাঁর বিজয়রথ। প্রথমবারের মতো তাঁর শপথে তিনি শামিল করিয়েছেন এই অঞ্চলের সরকার প্রধানদের৷ প্রথম সিদ্ধান্তেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ভারতরত্ন উপাধি দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আবারও জয় করে নিয়েছেন ভারতীয় অহং৷
মোদির জয়ে আমাদেরও খুশি না হয়ে উপায় নেই। মোদির জয়ে খুশি হয়েছে বিএনপি-আওয়ামী লীগ। গোপনে গোপনে খুশি হওয়ার কথা জামায়াতে ইসলামীরও। ক্যু করে গড়ে তোলা জাতীয় পার্টি এখন নিজেই তার দলের ভেতর আওয়ামী ‘ক্যু’-তে দিশেহারা। তা না হলে মোদিবন্দনায় শামিল হতে হয়তো দেখা যেত এরশাদকেও।
মোদির শুধু বন্দনা হলে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এতেই থেমে থাকবে না। মোদির মন পাওয়ার জন্য বিএনপি আর আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামবে, প্রয়োজনে দেশের স্বার্থকে বন্ধক রেখে। যেকোনোভাবে ক্ষমতায় থাকতে বদ্ধপরিকর আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় সবকিছু দিয়ে দিয়েছে ভারতকে। বাকি আছে শুধু সরাসরি সড়কপথে ট্রানজিট। ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনে তাও ভারতকে দিয়ে দিতে পারে সরকার। আবার ক্ষমতায় যেতে মরিয়া বিএনপি একই রকমভাবে মোদির মন খুশি করতে রাজি হয়ে যেতে পারে যেকোনো শর্তে। মোদি সরকারের এই সুযোগ নিতে পিছপা হওয়ার কথা নয়! ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহ দমন, বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং এসব রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার প্রয়োজনে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট খুব লোভনীয় হওয়ার কথা মোদির কাছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কি এমন সম্ভাবনা সামনে রেখে দেশের স্বার্থের কথা ভাববে, নাকি নিজেদের ক্ষমতায়নের কথা?
দুই:
বিএনপি নেত্রী বলেছেন, বিজেপির বিজয়ে নয়, তারা আসলে খুশি হয়েছেন কংগ্রেসের পরাজয়ের কারণে৷ কংগ্রেস সরকারের সক্রিয় সমর্থনের কারণে বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সম্ভব হয়েছে, কংগ্রেসের মতোই পরাজয় বরণ করার কথা যে দলের, সেই আওয়ামী লীগ একতরফা ও অদ্ভুত এক নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় এসেছে৷ কংগ্রেস সরকারের একজন আমলা বাংলাদেশে এসে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঠেকানোর জন্য এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন৷ সেই কংগ্রেস নিজের দেশের মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে ধরাশায়ী হয়ে বিদায় নিয়েছে৷ বিএনপি তাই খুশি হতে পারে। কিন্তু মোদি যেভাবে ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ বিতাড়িত করার হুমকি দিয়েছেন, তাতে খুব একটা বিচলিত কেন হয়নি বিএনপি?
মোদি মুসলমান আর বাংলাদেশবিদ্বেষী—এ ধরনের প্রচারণা আছে, বহু লোক তা বিশ্বাসও করেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ আর ধর্মভিত্তিক জাতিসত্তা উভয়ে বিশ্বাসী বিএনপি কি সেটিও আমলে নিচ্ছে খুশি হওয়ার আগে? পানি আগ্রাসন, সীমান্তে কড়াকড়ি এবং অপদখলীয় জমি প্রত্যর্পণে কংগ্রেসের চেয়েও বেিশ কড়া নীতি গ্রহণ করার কথা বিজেপির। মোদির বিজেপি মোররাজি দেশাইয়ের জনতা দল বা অটল বিহারি বাজপেয়ির বিজেপি নয়। এসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোরভাবে জাতীয় স্বার্থই বিবেচনা করা হবে, তা মোদির বিজেপি পরিষ্কার করে বলেছে বহুবার। বিএনপি কি আদৌ বিচলিত তা নিয়ে?
মোদির বিজয় না হোক, কংগ্রেসের পরাজয়ে বিএনপির আনন্দ, তা না হয় বুঝতে পারা গেল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার মোদির বিজয়ে আসলে খুশি কি? কংগ্রেস আওয়ামী লীগের সহজাত বন্ধু৷ কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগ উভয় দলই স্বাধীনতা সংগ্রামের মালিকানা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দল দুটোর নেতাদের মধ্যে গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক ও কালোত্তীর্ণ সম্পর্ক। বিজেপির সঙ্গে এসব মিল নেই আওয়ামী লীগের; বিজেপির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে দলটির নেতাদের ঘনিষ্ঠতার কথাও শোনা যায় না৷ তবু আওয়ামী লীগ সরকার মোদিকে সর্বতোভাবে স্বাগত জানিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শকেরা হয়তো বুঝতে পারেননি মোদির শপথ নিতে দেরি হতে পারে, নাহলে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও হয়তো দেখতাম মোদির শপথ অনুষ্ঠানে৷ সেটি হলে আওয়ামী লীগ তো বটে, হয়তো বাংলাদেশের জন্যও ভালো হতো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতি অবশ্য কিছুটা হলেও সামাল দিয়েছেন আমাদের স্পিকার৷ মোদির সঙ্গে আলোচনা শেষে তাঁর উচ্ছ্বাস আর কৌশল এই বার্তা দিয়েছে যে কংগ্রেসের মতো বিজেপির ক্ষেত্রেও একই ভারতনীতি অনুসরণ করবে বর্তমান সরকার। মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি বলেছেন, তিস্তা চুক্তি আর সীমান্ত চুক্তি মোদি ‘সক্রিয় বিবেচনার’ আশ্বাস দিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব অবশ্য বলেছেন, এগুলো তিনি ‘বিবেচনার’ আশ্বাস দিয়েছেন৷ অথচ মাত্র গতকাল তাঁর দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে রাজ্য সরকারগুলোর স্বার্থ নিশ্চিত করা তার সরকারের অগ্রাধিকার বলে জানিয়েছেন মোদি৷ মোদি কি মমতাকে চটিয়ে বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেবেন? এটি ‘সক্রিয়ভাবে’ আদৌ কি বিবেচনা করবেন? মনে হয় না৷
স্পিকার শিরীন শারমিনের বক্তব্য আবারও একধরনের অসার আশাবাদ তৈর করেছে সম্ভবত৷ মোদির সঙ্গে বৈঠকে সীমান্ত অনুপ্রবেশকারী বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল৷ ভারতীয় সচিবের বক্তব্যে আমরা জেনেছি, বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন মোদি। শিরীন শারমিন কি তখন ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ বিতাড়ন করা হবে বলে মোদির বক্তব্যে বাংলাদেশের উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছিলেন? মনে হয় না। সেটি হলে তিনি সীমান্ত বিষয়ে আলাপ হয়েছে, এটি তাঁর বক্তব্যে চেপে যেতেন না। তাঁর এ ধরনের মনোভাবে ইঙ্গিত রয়েছে যে সীমান্তে ভারতীয় কড়াকড়ি নিয়ে কংগ্রেস আমলের মতো বিজেপি আমলেও যতটা পারা যায় ‘পিঠ পেতে কিল হজম’ করার নীতি গ্রহণ করবে আওয়ামী লীগ সরকার।
তিন:
এসব উৎকণ্ঠা দেশের অসুস্থ রাজনীতির কারণে৷ ২০০৬ সালে বিএনপি এবং ২০১৩-১৪ সালে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে, যেনতেন নির্বাচন করে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে বদ্ধপরিকর দল দুটো৷ ২০০৬ সালে দেশ-বিদেশি বিভিন্ন মহলের সোচ্চার প্রতিবাদের কারণে বিএনপি তা করতে পারেনি। ২০১৩-১৪ সালে সেই সোচ্চার ভূমিকা অনেকেই পালন না করার জন্য এবং ভারত সরকারের অন্ধ সমর্থনের জোরে আওয়ামী লীগ তা করতে পেরেছে। আওয়ামী লীগ কি তার প্রতিদান দেবে না, বিশেষ করে ভারতকে?
শেখ হাসিনার প্রথম সরকারসহ নব্বই-পরবর্তী তিনটি সরকারের আমলে ভারতকে একতরফাভাবে বহুকিছু দিয়ে দেওয়া হয়নি৷ শেখ হাসিনার দ্বিতীয় আমলে তা হয়েছে। সেটি যে ক্ষমতায় থাকার জন্য কংগ্রেস সরকারের অন্ধ সমর্থনের আশায়, তা বহু মানুষ বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করার কারণও আছে। কংগ্রেসের বদলে বিজেপি এসে এ রকম সমর্থন দিলে বর্তমান সরকার ভারত তোষণনীতি অব্যাহত রাখবে, এটি তাই স্বাভাবিক। ক্ষমতায় যাওয়ার তথা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের পক্ষে সমর্থন পেলে বিএনপিও দেশের স্বার্থ নিয়ে খুব ভাববে বলে মনে হয় না।
অথচ দেশের প্রধান দুটি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সবার আগে প্রয়োজন মোদি সরকারের বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করা। ডন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, মোদি বহুজাতিক করপোরেশনের পাহাড়, জঙ্গল আর নদী নিয়ে ব্যবসা নিরাপদ করার জন্য এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা নিজের দেশের গরিব ও প্রান্তিক মানুষের বিরুদ্ধে নির্মম হতে পিছপা হবেন না। তাঁর মতে, মোদির উন্নয়ন মডেল উচ্চমধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের জন্য৷
মোদির উন্নয়ন মডেলে প্রতিরোধ এলে, উন্নয়ন ব্যাহত হলে তিনি ধর্মান্ধতার রাজনীতির খেলা খেলতে পারেন। স্ক্রোল-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ফ্রান্সের রাজনীতি-বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফি জ্যাফরেলো বলেছেন, মোদির প্ল্যান ‘এ’ হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এটি ব্যর্থ হলে তাঁর প্ল্যান ‘বি’ হবে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়া৷ গার্ডিয়ান পত্রিকায় পঙ্কজ মিশ্র এসব দিকের ইঙ্গিত করে মোদির ক্ষমতারোহণকে একটি নতুন বিপদসংকুল অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মোদি যদি সত্যিই হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করেন, তাহলে সীমান্ত দিয়ে তথাকথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের পুশ-ইন করার চেষ্টা হবে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নতুন করে আক্রান্ত হবে৷ মোদি এসব না করলেও ভারতের কাছ থেকে পানি, মাটি আর সীমান্ত নিরাপত্তার বহু অধিকার রয়ে যাবে অনাদায়ি।
এসব নিয়ে হয়তো ভাবছেন আমাদের রাজনীতিবিদেরা৷ কিন্তু আমার সন্দেহ, তার চেয়ে বহুগুণে তাঁরা ভাবছেন মোদির সমর্থন নিয়ে ক্ষমতার যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার কথা।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
(সূত্র: প্রথম আলো)