বাংলাদেশে সেকুলারিজমের অনুবাদ করা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’। কিন্তু এ অনুবাদ সঠিক নয়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কথাটি সেকুলারিজমের প্রকৃত তাৎপর্য প্রকাশ করে না। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় এবং জনগণ প্রকৃত বিষয়টি বুঝতে পারে না।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রকৃত তাৎপর্য হলো, রাষ্ট্র ও শিক্ষাকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করা। সেকুলারিজমের উদ্ভব হয়েছিল এনলাইটেনমেন্ট আন্দোলন বা ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের মাধ্যমে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ আন্দোলন শুরু হয় ফ্রান্সে এবং ইউরোপের আরো কিছু দেশে। এটা ছিল ধর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন। তাদের মূল কথা ছিল দু’টি। প্রথমত, ন্যাচারালিজম (Naturalism)। অর্থাৎ সৃষ্টি প্রাকৃতিকভাবে হয়েছে। এখানে ‘স্রষ্টা’ বলে কোনো সত্তার ভূমিকা নেই। অর্থাৎ এটি স্রষ্টাকে অস্বীকার করারই শামিল। দ্বিতীয়ত, রেশনালিজম (Rationalism) বা যুক্তিবাদ। অর্থাৎ মানুষ জীবনে চলার ক্ষেত্রে যুক্তির ভিত্তিতে চলবে, স্রষ্টা বা ওহি বা ধর্মগ্রন্থের নির্দেশের ভিত্তিতে নয়। এটাও নাস্তিকতারই নামান্তর। এ দু’টি ছিল এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্টের মূল কথা। এ চিন্তাধারারই প্রায়োগিক বিস্তার ঘটেছে সেকুলারিজমের নামে। কোথাও এর প্রয়োগ নাস্তিকতার রূপ নিয়েছে; যেমনÑ রাশিয়া, চীন ও কমিউনিস্ট দেশগুলোয়। অন্যান্য দেশে এটা রাষ্ট্র ও শিক্ষাকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে; যেমনÑ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ইত্যাদি। এসব দেশে সরকারি কিংবা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা দেয়া হয় না। তবে প্রত্যেক ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের নিজের অর্থে নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তা করাও হয়। ভারতের শিক্ষাকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সরকারি কোনো স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ নেই। তবে বেসরকারি স্কুল ধর্মশিক্ষা দিতে পারে। তবে তারা সরকারি সাহায্য নিতে পারবে না।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ ধরনের ব্যবস্থার সাথে ইসলাম বা কোনো ধর্মেরই কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো ধর্মই এ ধরনের ব্যবস্থা সমর্থন করে না। ইসলামের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, রাসূলুল্লাহ সা: নিজেই মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার আইন ছিল ইসলামি শরিয়াহ। খেলাফতে রাশেদার সময়ও রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ইসলাম ও ইসলামি আইন। একই কথা সত্য উমাইয়া, আব্বাসি ও উসমানি খিলাফতের ব্যাপারে এবং মোগল রাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। আল্লাহ হচ্ছেন মালিকিন নাস (মানুষের শাসক, সূরা নাস) এবং মালিকাল মুলক (রাষ্ট্রের মালিক, সূরা আলে ইমরান)। কোনো মুসলিমই আল্লাহর চূড়ান্ত ক্ষমতা অস্বীকার করতে পারে না।
সেকুলার ব্যবস্থা বিশ্বে কম-বেশি দুই শ’ বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত আছে। এতে তেমন কোনো কল্যাণ হয়নি। সেকুলারিজমের গর্ভ থেকে কমিউনিজম ও ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়েছে। এসব মতবাদ মানুষের কোনো কাজেই লাগেনি। সেকুলারিজমের কারণেই উগ্র পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছে, যার মাধ্যমে সারা বিশ্বের সম্পদ লুট করে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেকুলার শাসকেরাই বিশ্বে দেশে দেশে উপনিবেশ বানিয়েছে। সারা বিশ্বকে দাস বানিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসব উপনিবেশ মুক্ত হয়েছে। সেকুলার শাসকদের কারণেই বিশ্বে প্রথম মহাযুদ্ধ ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ হয়েছে। ভিয়েতনাম ও আলজেরিয়াসহ বহু দেশে রক্তপাত হয়েছে।
সেকুলারিজমের প্রকৃত অর্থ না জানার কারণেই অনেক লোক নামাজ পড়ে, আবার সেকুলার হিসেবে পরিচয় দেয়। সেকুলারিজমের অর্থ বুঝলে এ বিভ্রান্তি দূর হবে। এখন ইসলামি মন বা ধার্মিক মন এবং সেকুলার মনের পার্থক্য তুলে ধরেছি। ইসলামি মন হলো সেই মন, যা কোনো সমস্যা দেখা দিলে তার সমাধান খোঁজে কুরআন ও সুন্নাহতে, পরে অন্যান্য দিকে। অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে তাদের ধর্মের মধ্যে সমাধান খোঁজে, পরে অন্য দিকে। কিন্তু সেকুলার মন সমাধান খোঁজে বিভিন্ন পণ্ডিতের মতামতে; যুক্তরাষ্ট্র কী করে, রাশিয়া কী করে, চীন কী করেÑ এসব দিকে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামিমনাদের দায়িত্ব সেকুলারমনাদেরকে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনা। এ জন্য তাদেরকে ইসলামের মৌলিক কিছু বই পড়াতে হবে। আশা করি, এতে ভালো ফল হবে।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
লেখাটি লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া